ম্যাকিয়াভেলি, এরিস্টটল এবং গেম অব থ্রোনস

ম্যাকিয়াভেলি, এরিস্টটল এবং গেম অব থ্রোনস

পরিচালক জর্জ আর আর মার্টিন “Game of Thrones” নির্মানের সময় ফিলোসফির সাহায্য নিয়েছেন কিনা তা বলা মুশকিল, কিন্তু এই জনপ্রিয় টিভি সিরিজের চরিত্রগুলো বিশ্লেষনের সময় ফিলোসফির সাথে এক ধরনের নিবিড় যোগাযোগ আমরা লক্ষ্য করি। যদিও এর অনেক কাহিনীই ইতিহাস থেকে সরাসরি নেয়া হয়েছে। যেমন ‘রেড ওয়েডিং’ এর হত্যাকান্ডের ঘটনাটি স্কটল্যান্ডের ‘ব্ল্যাক ডিনার’ থেকে সরাসরি নেয় হয়েছে, যা পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন। ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে “Game of Thrones and Philosophy” কোর্স চালু করা হয়েছে। হেনরি জেকবির “Game of Thrones and Philosophy: Logic Cuts Deeper Than Swords” নামক বইটি নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলিং এও উঠে আসে ২০১৩ সালে। সব মিলিয়ে গেম অব থ্রোনস এর ফিলোসফিকাল গ্রাউন্ডিংকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

 

টাইউইন ল্যানিস্টার এবং রিলেটিভ মোরালিজম

ক্ষমতা দৃঢ় করার লক্ষ্যে টাইউইন ল্যানিস্টারের নির্মম নেতৃত্ব আমাদের মনে যে নামটি প্রথমেই আনে তা হল নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রতারণা কিংবা শঠতার আশ্রয় নেয়াকে দার্শনিকভাবে জায়েজ করার প্রক্রিয়া ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম দিয়ে শুরু হয় যা আমরা “দ্যা প্রিন্স” গ্রন্থে দেখতে পারি। ম্যাকিয়াভেলির মতে “রাজনীতিতে প্রতারনা বলতে কিছু নেই, যা থাকে তা হল রাজনৈতিক কৌশল”। রবার্ট বারাথিয়ন এবং নেড স্টার্ক যখন কিংস ল্যান্ডিং আক্রমন করেন তখন ম্যাড কিংকে রক্ষার ভান করতে ক্যাস্টারলি রকস থেকে টাইউইন মার্চ শুরু করেন এবং একই সাথে বিদ্রোহীদের আশ্বাস দেন যে তিনি নিউট্রাল থাকবেন। এই জায়গায় তিনি ম্যাকিয়াভেলির দর্শনকেওছাড়িয়ে যান।

joban-got2সিজন-৩ এর নবম পর্বে টাইউইন টিরিয়নকে বলেন, “কিছু যুদ্ধ জেতার জন্য তলোয়ার এবং বর্শার প্রয়োজন হয়, বাকিগুলো কলম এবং দাঁড়কাকের মাধ্যমেই জেতা সম্ভব”। স্যার ওয়েল্ডার ফ্রে এর সাথে চুক্তি করে রেড ওয়েডিং এ রব স্টার্ককে হত্যার মধ্য দিয়ে তিনি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। নিষ্ঠুরতা থাকলেও টাইউইন এই নিষ্ঠুরতার একটা মোরাল গ্রাউন্ডিং তৈরি করেন। রেড ওয়েডিং এর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাপক রক্তপাত ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল, এটাই তার ব্যাখ্যা। এখানে তার দর্শন ‘রিলেটিভ মোরালিজম’ যা ম্যাকিয়াভেলিনিজমে স্পষ্ট দেখা যায় “সম্ভব হলে মোরাল থাকা ভাল, কিন্তু যদি ফলাফল অর্জনের জন্য যদি অন্য কোন সঠিক পথ থাকে তাহলে সেটাই বেছে নিতে হবে”। অনেক ক্ষেত্রেই টাইউইন ল্যানিস্টারকে নিষ্ঠুর বলা যায় না, বরং সময় ও পরিস্থিতি তাকে নিষ্ঠুর বানায়। ক্ষমতার উত্তরাধিকার অর্জন এবং তা টিকেয়ে রাখার জন্য তিনি নিজের সন্তানদের দাবার গুটি হিসেবেও ব্যবহার করতেন এবং তার পিছনে ফিলোসফিকাল গ্রাউন্ড হিসেবে ছিল “রিলেটিভ মোরালিজম”।

এরিস্টটলের দৃষ্টিকোণ থেকে টাইউইন চরিত্রটি ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয় তা অনেকটা ‘লোগোস’ (লজিক এন্ড রিসোনিং) ধারণাটির সাথে সম্পর্কিত। প্রতি প্রদক্ষেপেই টাইউইন এর মোরাল গ্রাউন্ডিং ছিল লজিক এবং রিজনিং এর উপর ভিত্তি করে। ল্যানিস্টার শব্দটি প্রথমেই আমাদের মনে যে ইমেজ তৈরি করে তা হল “A Lannister always pays his debts”। এই উক্তিটি খুব শক্তভাবে লোগোস আইডিয়া দ্বারা প্রভাবিত যার মধ্যে আমরা ‘লজিক এন্ড রিজনিং’ দেখতে পাই। যেমন ল্যানিস্টার আর্মিতে অন্যরা কেন যোগ দিবে? তাদের খ্যাতি অথবা সম্মান কোনটার কারণেই নয়, বরং ‘lannisters always pay their debts’। ড্যানি যখন ওয়েস্টেরোস এ আক্রমণ করে তখন স্যার টার্লির সাথে জেইমির আলাপচারিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। জেইমির পয়েন্ট ছিল যখন পক্ষ নেয়ার প্রশ্ন আসে তখন কাদের পক্ষে থাকা যুক্তিযুক্ত? ওয়েস্টেরোস এর জনগণের নাকি বহিরাগত আক্রমণকারীদের? এবং এটাও জোর দিয়ে বলেন যে, ল্যানিস্টার পে দেয়ার ডেটস। যুদ্ধে জয়ী হলে সাউথ এর দায়িত্ব টার্লিকে দেয়া হবে এই প্রত্যাশা জেইমি দেন। এখানে আমরা ‘লজিক এন্ড রিজনিং’ এর সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করি। ল্যানিস্টারদের অবস্থান আদর্শিক অবস্থান তাই একই সাথে ম্যাকিয়াভেলির “রিলেটিভ মোরালিজম” এবং এরিস্টটলের “লোগোস” দ্বারা প্রভাবিত।

 

নেড স্টার্ক এবং ‘এবসুলেইট মোরালিজম’

টাইউইন এবং ড্যানি যদি ‘রিলেটিভ মোরালিজম’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, নেড স্টার্ককে তাহলে বলতে হয় ‘এবসুলেট মোরালিজম’ দ্বারা প্রভাবিত। এই আদর্শিক অবস্থান পরবর্তীতে তার ছেলে রব স্টার্ক এর মধ্যেও প্রবাহিত হয়। নেতিবাচক ফলাফলের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তাদের আদর্শিক অবস্থান ছিলো সততা এবং জাতিগত সম্মানের ইতিহাস থেকে এক বিন্দুও বিচ্যুত না হওয়া।

joban-got3

এরিস্টটল তার “Nicomachean Ethics” এ বলেন, মোরালিটি এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত, অভ্যাসগত এবং সেলফ ট্রেইনিং যা শুধুমাত্র মোরালিটির স্বার্থেই হতে হয়, ম্যাটেরিয়াল কোন প্রাপ্তির আশায় নয়। নেড চরিত্রটির বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পারি তিনি রেগারের সন্তানদের হত্যা কিংবা ড্যানিকে গুপ্তহত্যার পক্ষে ছিলেন না। জন এরণের হত্যার রহস্য উদঘাটন এবং রবার্ট বারাথিয়নের আসল উত্তরাধিকার কে হবে তা জানার জন্য নিজের জীবনকে এমনকি হাউজ স্টার্ককেই এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেন। টাইউইন যেখানে জনগনকে ভয়ের মাধ্যমে শাসনের পক্ষপাতী, নেড সেখানে সম্মান অর্জনের মাধ্যমে শাসনের পক্ষপাতী। হাউজ স্টার্ক এর দৃঢ় আদর্শিক অবস্থানের কারণে মূল সুবিধা হয় ম্যাকিয়াভেলিবাদ মতাদর্শে বিশ্বাসীদের। পিটার বেলিশ জানতেন এই আদর্শিক অবস্থান স্টার্ক পরিবারের ধ্বংসের কারণ হবে এবং নেডকে তিনি সতর্ক করেছিলেন এই বলে, “আপনি ভাবছেন আপনার সম্মান অথবা খ্যাতি আপনাকে রক্ষা করবে, কিন্তু এটা এক ধরণের বোঝা যা আপনার পদক্ষেপকে ধীর করে দিবে”। প্রকৃতপক্ষে তাই হয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো মূলত স্টার্করা ল্যানিস্টারদের কাছে পরাজিত হয়নি বরং “এবসুলেইট মোরালিজমের” পরাজয় হয়েছে “রিলেটিভ মোরালিজমের” কাছে।

সক্রেটিস তার মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “আদর্শিক কোন মানুষ তার বাচা-মরা নিয়ে চিন্তা করে না, বরং সে চিন্তা করে তার আদর্শিক অবস্থানের পজিশনিং নিয়ে”। নেড স্টার্কের জীবনও এর ব্যাতিক্রম নয়। কিংস ল্যান্ডিং এর বিরুদ্ধ পরিবেশে তার সত্য অনুসন্ধানের চেষ্টা তাই প্রমাণ করে। যদিও মৃত্যুর আগে তার পরিবারের কথা চিন্তা করে কিং জফরির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা তার দীর্ঘ জীবনের আদর্শিক অবস্থান এবং সম্মানকে একটু হলেও ফ্যাকাশে করে। তারপরও স্ট্যানিস এর ভাষায় বলতে হয়, “এমনকি বোকারাও নেড স্টার্ক এর সম্মান এবং খ্যাতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না”।

নেড এবং রব এর মোরাল গ্রাউন্ডিং ব্যাখ্যা করা যায় এরিস্টটলের ‘ইথোস’ (ইথিকস এন্ড ক্যারেক্টার) দিয়ে। ইথোস বলতে এরিস্টটল বুঝিয়েছেন ইথিকস এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা একটি চরিত্র যা সর্ব অবস্থায় এমনকি নেতিবাচক ফলাফল সত্ত্বেও তার ইথিকস থেকে বিচ্যুত হয় না। তাই যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনেও রব স্টার্ক ন্যায়বিচার প্রত্যাশার জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যান যা পরবর্তীতে স্টার্ক হাউজের জন্য আরো বড় বিপদ ডেকে আনে।

 

ডেনারিস টারগেরিয়ান

জ্যাঁ জ্যাক রুশো তার ‘The Social Contact’ এর শুরুতে বলেন, “Man is born to free but everywhere there is a chain”। “Daenerys Stormborn of the House Targaryen, First of Her Name, the Unburnt, Queen of the Andals and the First Men, Khaleesi of the Great Grass Sea, Breaker of Chains, and Mother of Dragons” ড্যানি প্রথম থেকেই চায় সেই শিকল থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। এসস থেকে মেরিন ড্যানির প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো দাসদেরকে মুক্ত করা, তাদেরকে স্বাধীন করে দেয়া। রুশো এবং ড্যানি দুইজনই বিশ্বাস করেন সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা মানুষের স্বাধীনতা এবং মানবিকতা কেড়ে নেয়।

টাইউইন এর মত ড্যানিও “রিলেটিভ মোরালিজম” এর উপর ভরসা রাখেন। “The end justifies the means” অর্থাৎ শেষ লক্ষ্য যদি ভাল কিছু হয় তাহলে সেটা অর্জনের জন্য অনেক সময় মোরাল জায়গা থেকে সরে আসা যায়। মেরিনের ১৬৩ জন মাস্টারকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় ড্যানির অবচেতন মনে ম্যাকিয়াভেলির ‘রিলেটিভ মোরালিজম’ একটা প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ম্যাকিয়াভেলির মতে, পর্যাপ্ত অস্ত্র, সৈন্যসহ নেতৃত্বের জন্য থাকে বিজয় এবং অন্যদিকে অস্ত্র, সৈন্যবিহীন নেতার জন্য থাকে দুর্দশা। ড্যানি এই বাস্তবতা খুব কাছ থেকেই উপলদ্ধি করেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন তার ‘slave free world’ এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভায়োলেন্সের বিকল্প নেই। ‘এসস থেকে মেরিন’ তার বিজয়যাত্রায় এবং পরবর্তীতে টারলিকে ড্রাগন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে ব্যাপক রক্তপাতের মধ্য দিয়েই সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখতে হয়।

ড্যানির মোরাল গ্রাউন্ডিংকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা এরিস্টটলের ‘প্যাথোস’ (আবেগকে  কাজে লাগানো) ধারণার আশ্রয় নিতে পারি। স্যাভাজেস থেকে আনসালিড সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখি যে ড্যানি আবেগকে ব্যবহার করেই একটি নেতৃত্ব তৈরি করেন।

গেম অব থ্রোনস এর প্রায় প্রতিটি ক্যারেক্টারেরই একটি করে ফিলোসফিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য এখানে শুধুমাত্র টাইউইন, নেড এবং ড্যানির ফিলোসফিক্যাল গ্রাউন্ড বলা হল। পর্যায়ক্রমে জন স্নো, টিরিয়ন, আরয়া, স্ট্যানিস, সানসাসহ অন্য চরিত্রগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।

সূত্র: উইন্টার ইজ কামিং ডটনেট