ব্রিটিশ উপনিবেশী শাসনব্যবস্থা থেকে দেশভাগ হয়ে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা লাভ- যার ক্যামেরার ঝলকানিতে এই পুরো ইতিহাস প্রামান্য-তথ্যচিত্র হিসেবে অমূল্য দলিল হয়ে আছে; তিনি হলেন ভারতের প্রথম নারী ফটো সাংবাদিক হোমাই ভীরাওয়াল্লা। আজও তিনি তাই উপমহাদেশের নারীমুক্তির এক উদাহরণ হয়ে আছেন।
১৯১৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর পশ্চিম ভারতের গুজরাটের ক্ষুদ্র কিন্তু বেশ প্রভাবশালী পার্সি জনগোষ্ঠীর একটি পরিবারে জন্ম হয় তার। পিতা একটি যাযাবর যাত্রাদলের অভিনেতা হওয়ার সুবাদে শৈশবের বেশিরভাগ সময় দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেই কাটাতে হয়েছিল তাকে। কিছুসময় পরে তার পরিবার স্থায়ীভাবে বোম্বাই(বর্তমান মুম্বাই) এ চলে এলে প্রথমে সেখানে সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং পরে ‘জে জে স্কুল অফ আর্ট ’ কলেজে এ ভর্তি হন তিনি। কলেজে থাকাকালীন সময়ে মানেকশাহ ভীরাওয়াল্লা নামের টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফারের সাথে পরিচয় হয় তার। সে সুত্রে মানেকশাহই প্রথম ক্যামেরার জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন হোমাইকে। প্রতিনিয়ত মুম্বাইয়ের অলিগলিতে ছবি তোলার নেশায় ঘুরে বেড়াতেন দুজন। সেখান থেকে সম্পর্ক প্রণয়ে গড়ালে পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। এর মাঝে কলেজে পড়ার সময়েই তার প্রথম কাজটা পেয়ে যান হোমাই – একটি পিকনিক দলের ছবি তুলে দেওয়ার কাজ নেন তিনি। তার তোলা সেই ছবিগুলো স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপা হলে দ্রুতই বেশ কিছু বাড়তি কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি।
একসময় ‘ফটোগ্রাফস অফ লাইফ ইন মুম্বাই’ শিরোনামে তোলা তার কিছু ছবি ‘দ্যা ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’ এ প্রকাশিত হলে ব্যাপক পরিচিতি পান মিস ভীরাওয়াল্লা। স্বামী মানেকশাহ ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিস’ এর ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজের ডাক পেলে ভীরাওয়ালা দম্পতি ১৯৪২ সালে মুম্বাই থেকে দিল্লীতে চলে আসেন। সেখানে সার্বক্ষনিক সঙ্গী প্রিয় স্পিড গ্রাফিক ক্যামেরাটাকে পিঠে ঝুলিয়ে প্রায়ই দিল্লীর রাস্তায় সাইকেলে চরে ঘুরতে দেখা যেত তাকে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে যান হোমাই। তার সবচাইতে প্রশংসিত ঐতিহাসিক ছবিগুলো মূলত ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় থেকেই তোলা। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের মুক্তি লাভের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু’র শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মত বিয়োগাত্মক স্মৃতিবহ ছবি ছিল তার সংগ্রহে। এছাড়া লাল বাহাদুর শাস্ত্রীসহ, তিব্বতের দালাই লামাসহ আরো অনেক প্রখ্যাত নেতৃবৃন্দের ছবিও তুলেছিলেন তিনি। এমনকি স্বাধীনতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার সময়ে ভারতের মাটিতে লর্ড মাউনব্যাটেন শেষ স্যালুট প্রদানের সেই ঐতিহাসিক মুহুর্তটিকেও নিজের ক্যামেরায় বন্দী করেছিলেন তিনি।
তবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, তার পেশাজীবনের সবচেয়ে বড় অনুশোচনা যে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয় সেই সংলাপ অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত হতে না পারা। পারিবারিক কোন বিশেষ প্রয়োজনে সেদিন তিনি সেখানে যেতে পারেননি এবং একজন ভারতীয় হবার সাথে সাথে একজন ফটোগ্রাফার হিসেবেও এ নিয়ে প্রচণ্ড দুঃখবোধ তার।
ধারাবাহিকভাবে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ভারত সফরে আসা বিদেশি অনেক তারকা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবিও তুলেছিলেন। যেমন চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন, মহারাণী এলিজাবেথ দ্বিতীয় এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দের ছবি তোলার সুযোগ হয়েছিল তার। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জনাব নেহেরুর ছবিই বেশি ছিল তার সংগ্রহে, যাকে তিনি নিজের প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলেও মনে করেন। জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর, তার ভাষ্যমতে, “বাকি আলোকচিত্রকারদের থেকে লুকিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদেছিলাম আমি”।
হঠাৎ ১৯৬৯ সালে জীবনসঙ্গী মানেকশাহ ভীরাওয়াল্লার অকস্মাৎ মৃত্যু হলে দিল্লী ছেড়ে জন্মভূমি গুজরাটে ফিরে যান মিস হোমাই। চল্লিশ বছরব্যাপী দীর্ঘ পেশাজীবনের শেষদিকে ১৯৭০ সালে নিজের শেষ ছবিটি তুলেন তিনি। ইতিহাসে এই বিরাট অবদানস্বরুপ ২০১১ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পদক ‘পদ্মা বিভূষণ’ পদে সম্মানিত করা হয় তাকে। শেষমেশ ২০১২ সালের ১৬ই জানুয়ারি ৯২ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। তার কাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দিল্লীর আলকাজি ফাউন্ডেশন ফর আর্টস এ সংরক্ষিত আছে।