তথ্যের এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে চিন্তা ভাবনা জরুরি। কাজটি আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। বরং তথ্যকে উল্টো বিনা পর্যালোচনায় গ্রহণ করে নেওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়। ফলে তথ্য-উপাত্ত সংক্রান্ত আলাপ সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু তথ্যের আছে শত্রু-মিত্র, এমন কি আছে রাজনীতিও। তথ্যবাদ বলে এক ধরণের মতবাদও দাঁড় করানো হয়েছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায়, মানুষের জীবনে তথ্যের দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন ইসরাইলি অধ্যাপক ইউভাল নোয়া হারারি। তার একটি ভাবানুবাদ প্রকাশ করা হল।
হাজার বছর ধরে মানুষের এক ধরনের বিশ্বাস ছিল যে, দুনিয়ায় খোদার শাসন চলবে বা দেব-দেবীর। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে মানবতাবাদের ধারণা, এই শাসন-কতৃত্বের ভার খোদা থেকে মানুষের হাতে এনে দিয়েছে। এই হস্তান্তরকে জাঁ জ্যাক রুশো তার ১৭৬২ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত এমিলি তথা শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থে তুলে এনেছেন। তিনি জীবনকে পরিচালনার নানা তরিকা খুঁজে বললেন, “আমি আমার রিদয়ের গভীরে যেয়ে দেখেছি, প্রকৃতির কোন কিছুই মুছে যায় না। আমার কি করা উচিত সে বিষয়ে কেবল আমি নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারি। আমি নিজে যেটা ভাল মনে করি, সেটাই ভাল। যেটা খারাপ মনে হবে, সেটাই খারাপ”। রুশোর মত আরো অনেক মানবতাবাদী চিন্তকই আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে, আমাদের অনুভূতি-আকাঙ্ক্ষাই যেকোন কিছুর মর্ম বা গুরুত্ব বুঝার ক্ষেত্রে সর্বশেষ উৎস। তাই আমাদের “স্বাধীন ইচ্ছাই” আমাদের উপর সবচেয়ে বেশী কর্তৃত্বশালী হতে পারে।
এখন এই কতৃত্বের এক ধরনের নতুন-জন্ম ঘটছে। আগে যেভাবে খোদার শাসনকে নানা ধর্মীয় পৌরাণিক গল্প-ঘটনা এবং পরবর্তীতে মানবতাবাদী শাসনকে নানা মানবতাবাদী চিন্তা-আদর্শ দ্বারা বৈধ করে দেওয়া হত। ঠিক সেভাবেই টেকনোলজির রথী-মহারথী এবং সিলিকন ভ্যালীর পয়গম্বররা এক ধরনের নতুন বৈশ্বিক বয়ান তৈরি করছে। যেটি আমাদের জীবন-নিয়ন্ত্রনকারী নানা গাণিতিক পরিভাষা (Algorithms) এবং বিশাল তথ্যভাণ্ডারকে জায়েজ করছে। এই পবিত্র বিশ্বাস বা চিন্তাকে বলা যায়, “তথ্যবাদ” বা “Dataism”। এই ধরনের ড্যাটাইজম-কেন্দ্রিক বিশ্বদৃষ্টির পক্ষে যারা ওকালতি করে তারা সমগ্র বিশ্বকে একটি ‘তথ্যের প্রবাহ’ হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তারা জীবদেহকে মনে করেন, এটি নিতান্তই কিছু জৈব-রাসায়নিক গণিতের সমীকরণ বৈ কিছু না। এবং তারা এও বিশ্বাস করেন যে, মানবতার একমাত্র কাজ যেটাকে বলা যায় এক ধরনের ‘মহাজাগতিক কারবার’ হচ্ছে, তথ্য-প্রক্রিয়াজাতকরণের এক বিশাল সিস্টেম বানানো। এবং সেখানে নিজেকে চিরতরে ভাসিয়ে দেওয়া।
আমরা অবশ্য এই বিশাল সিস্টেমে ছোট ছোট চিপসে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। যেটা আবার আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছি না। আমি নিজে প্রতিদিন ইমেইল-ফোন-প্রবন্ধ ইত্যাদি দিয়ে অগণিত তথ্য-উপাত্ত গিলে নিচ্ছি। সেগুলোকে নিজের মধ্যে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে আবার সেগুলো একই উপায়ে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমি জানি না, কিভাবে এই বিশাল ঘটনার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছি। কিভাবে আরো লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার এবং মানুষের তথ্য-উপাত্তের ভাণ্ডারে আমার তথ্যগুলোও যুক্ত হচ্ছে। যুক্ত হচ্ছি আমিও। কিন্তু এসব ভাবার সময় কই! কারণ সবগুলো মেইলের উত্তর যে দিতে হবে আমাকে আগে! এই ধরনের অবারিত তথ্যের প্রবাহ যেমন নতুন নতুন আবিষ্কারে সাহায্য করে। আবার নানা ধ্বংসের কারণও সে হতে পারে। এইসব ব্যাপারগুলোর পরিকল্পনা-নিয়ন্ত্রণ করা বা বুঝবার ক্ষেত্রে কারো হাত নেই।
আবার এই ব্যাপারগুলো কেউ গভীর মনে বুঝতেও চায় না। আগে তার ই-মেইলের উত্তর দেওয়ার কাজ। তারপর বাকি সব। ঠিক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রচলিত ‘কালো হাতের’ মত তথ্য-উপাত্তবাদে বিশ্বাসীরাও তথ্যপ্রবাহের এক অদৃশ্য কালো হাতে বিশ্বাস রাখেন। যেহেতু তথ্যের এই সিস্টেম দিনে দিনে সবজান্তা এবং শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এর সাথে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে যেকোন কিছু বুঝতে সুবিধা পাওয়া যাবে। তাই এই সময়ের সবেচেয়ে আলোচিত শ্লোগান হচ্ছে, “যা দেখ, তা করো রেকর্ড; যা করেছ রেকর্ড এবার হবে আপ্লোড; হলে আপ্লোড, শেয়ার করে জানাও দুনিয়া-তাবৎ”।
এই তথ্যবাদের হর্তাকর্তা বিশ্বাস করেন, বায়োমেট্রিক তথ্য এবং গণনার শক্তি দিয়ে এই সিস্টেম মানুষকে যেভাবে বুঝতে পারবে, খোদ মানুষ নিজেকেও এইভাবে বুঝতে পারবে না। এই রকম যদি কখনো হয়, তবে মানুষ তার আত্মনিয়ন্ত্রণ নিজেই হারিয়ে ফেলবে। এবং মানবতাবাদী যেসকল চর্চা সমাজে আছে যেমন: গণতান্ত্রিক নির্বাচন সেগুলো অনেকটাই সেকেলে হয়ে পড়বে। যেমন সেকেলে হয়ে গেছে বৃষ্টিতে নাচা কিংবা পাথরের ছুরির ব্যবহার।
যখন মাইকেল গোভ ব্রেক্সিটের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে মনোয়ন নিলেন। এবং তিনি বললেন, “আমি আমার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে নিজেকে একটি মাত্র প্রশ্ন সবসময়ে করেছি। তা হল কোন জিনিসটি ঠিক আর সেই বিষয়ে আমার রিদয় কী বলে?”। তাই তার ব্রেক্সিটের পক্ষে লড়াই করতে যেয়ে তার সাবেক রাজনৈতিক মিত্র বরিস জনসনকে নানা ভাবে হেনস্তা করতে পিছপা হননি তিনি এবং এইভাবেই তিনি নিজেকে দলে নেতা হিসেবে প্রমাণে লড়াই করেছেন। এসবই করেছেন কারণ তার মন এটাকেই সঠিক ভেবেছে।
এই ধরনের কঠিন সময়ে শুধু গোভ নয়। অনেকেই নিজের মনের কথা শোনেন। গত কিছু শতক ধরে এইভাবেই মানবতাবাদ মানুষের মনকেই কতৃত্ব ফলানোর একমাত্র উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছে। এই কতৃত্ব কেবল রাজনীতি নয় বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে। ছোটবেলাতেই আমাদের ভিতরে কিছু মানবতাবাদী শ্লোগান মুখস্থ করিয়ে আমাদের জীবনযুদ্ধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। “নিজের রিদয়ের আওয়াজ শোনো, নিজের কাছে সৎ হও, নিজেকে বিশ্বাস করো, রিদয়কে অনুসরণ করো, যা করে তুমি শান্তি পাও ঠিক তাই করো”।
গুগল হয়ত গম্ভীর গলায় উত্তরে বলবে, “দেখো মা বুবলী, তোমাকে সেই জন্মের পর থেকে দেখছি। আমি তোমার চালাচালি করা সকল ই-মেইল পড়েছি, তোমার সকল ফোনকলের রেকর্ড ও আমার কাছে আছে, তোমার প্রিয় সিনেমা থেকে তোমার ডিএনএ এমনকি তোমার রিদয়ের পুরো বায়োমেট্রিক-ইতিহাস আমি জানি। তুমি কোথায় কবে শাকের আর বাকেরের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে সেগুলোর দিন-তারিখ-সময়সহ যেমন জানি। তেমনি আমার কাছে আছে তখনকার তোমার প্রতি মুহুর্তের রিদয়ের স্পন্দন, রক্তচাপ এমনকি তোমার তখনকার শরীরের স্যুগার লেভেল পর্যন্ত জানা আছে আমার। ফলে শাকের-বাকেরকে তুমি যেভাবে চেনো। আমিও ঠিক সেভাবেই চিনি। একই রকমভাবে চিনি। তাই আমি বলি শোন, আমার কাছে আজ অব্দি যত তথ্য-সমীকরণ আর সমগ্র বিশ্বের কয়েক মিলিয়ন প্রেমের সম্পর্কের ব্যাপারে যে তথ্য আছে সেসব থেকে বলি। বাকেরকে বিয়ে করলে তোমার সুখী হবার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ”
রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি শাসন কার চলবে, তা নির্ভর করে সাধারণ ভোটারদের ওপর। আর বাজার অর্থনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি। ক্রেতা কখনো ভুল করতে পারে না। মানবতাবাদী শিল্প সবসময়ে দর্শকের চোখের সৌন্দর্য্যকে প্রাধান্য দেয়, আবার মানবতাবাদী শিক্ষা সবসময়ে নিজেকে নিয়ে ভাববার কথা বলে। ঠিক একইভাবে মানবতাবাদী নৈতিকতা আমাদের কাছে প্রচার করে, তোমার যা ভাল লাগে সেদিকেই এগিয়ে যাও এবং সেটাই করো।
ঠিক একইভাবে এটাও সত্য যে, মানবতাবাদী নৈতিকতা আবার নানা জটিল পরিস্থিতিতেও পড়তে পারে। যেমন, একটি ব্যাপার আপনার কাছে ভাল লাগছে সেটা আবার অন্যের খারাপ লাগছে। উদাহরণ দিতে চাইলে বলা যায়, গত দশক ধরে আমাদের ইসরাইলের জেরুজালেমে একটি সমকামীদের প্যারেড হয়। এই একটি মাত্র দিনে এইখানে এক ধরনের ‘ধর্মীয়-সম্প্রীতি’ দেখা যায়। কারণ এই প্যারেডের দিনেই এই সংঘর্ষময় শহরে ইয়াহুদী-মুসলিম-খৃষ্টান একইসাথে এই প্যারেডের বিরুদ্ধে কথা বলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা ধর্মীয় কট্টরবাদীদের মত করে চিন্তা করে না। তারা বলে না, “এই ধরনের সমকামীদের প্রকাশ্য প্যারেড তোমরা করতে পারো না, কারণ এটা ধর্মে নিষিদ্ধ”। বরং তারা টিভিতে-মিডিয়াতে বলে, “এই ধরনের প্যারেড পবিত্র জেরুজালেমে হতে দেখতে আমাদের কষ্ট হয়। সমকামীরা যেমন চায়, আমরা তাদের চিন্তাকে সম্মান করি। আমরাও চাই তারাও আমাদের অনুশাসন-অনুভূতিকে সম্মান করবেন”। এই ধরনের ধাঁধাঁ নিয়ে জানিনা কে কী ভাবছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মানবতাবাদী সমাজকে বুঝতে পারা। সেখানে কিভাবে নৈতিক-রাজনৈতিক তর্কগুলোকে ‘অনুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বর্গীয় আদেশের কথাগুলোকে সেভাবে সামনে আনা হয় না।
এখনো তাই মানবতাবাদ এক ধরনের অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে। এবং “স্বাধীন চিন্তা”র আইডিয়াটাও ঝামেলায় পড়ছে। আমাদের দেহ ও মস্তিস্ক কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক নানা মত বলছে যে, আমাদের অনুভূতি কোন ভিন্ন মানবিক আধ্মাতিকতার সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং এই ধারণাগুলো বলছে, অনুভূতিগুলো আদতে কিছু জৈব-রাসায়নিক কার্যকলাপ। যেগুলোকে সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে এই সিদ্ধান্তগুলো নিতে তারা ব্যবহার করে তাদের টিকে থাকা। এবং সৃজনশীলতার সম্ভাব্যতার নানা হিসাবের উপর ভিত্তি করে।
অনূভুতি কখনো যুক্তিবাদ (rationality) এর বিপরীতের কিছু না, যদিও এর উল্টো চিন্তাটাই আজকাল আমাদের মাঝে জনপ্রিয়। বরং অনুভূতিও একধরনের যৌক্তিক চিন্তার ফসল। যখন কোন বানর কিংবা জিরাফ বা মানুষ কোন সিংহ দেখে, তাদের ভয়ের পারদ উপরে উঠতে থাকে। কারণ তাদের জৈব-রাসায়নিক নানা সমীকরণ নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলছে, এইখানে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি আছে। একইভাবে, আমাদের কখনো কখনো যৌন-আকর্ষণ জাগ্রত হয়, কেননা শরীর কোনভাবে হিসেব করে বের করতে পারে যে, এই মূহুর্তে একটি সঙ্গমের সমূহ সম্ভাবনা আছে। এই জৈব-রাসায়নিক হিসেবগুলো একদিনের নয়। বরং বহু মিলিয়ন বছর ধরে এর এক ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে। যদি অতীতে কোন অনুভূতি কোন পূর্ব-পুরুষকে ভুল সিগনাল প্রদান করে থাকে। তাহলে মানব-জিনগুলো পরবর্তী-প্রজন্মে সেই নির্দিষ্ট অনুভূতিটিকে আর ছড়াতে দেয় না।
২০১৩ সালে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি একটি জেনেটিক টেস্ট করিয়ে জানতে পারেন যে, তার শরীরে BRCA1 নামের জিনের বিপজ্জনক পরিবর্তন হচ্ছে। তথ্য-উপাত্তমতে, এই ধরনের জিনবাহী যেকোন নারীর স্তন ক্যন্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৮৭ শতাংশ। যদিও জোলি ক্যান্সার-সংক্রান্ত কোন সমস্যাই ছিল না। তবুও তিনি এই রোগ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য চিকিৎসা নিলেন। এবং তিনি তার স্তন কর্তন করলেন। তিনি কিন্তু তার আগে সামান্য অসুস্থতা বোধও করেননি, তবুও তিনি চোখ বুঝে এই তথ্য-উপাত্তে “ঈমান” এনেছিলেন
অনুভূতি সব সময়ে স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এই ভুল চিন্তাটা যদিও মানবতাবাদীরা করে। তারপরেও মানবতাবাদ এক্ষেত্রে একটি চর্চার রাস্তা তৈরী করতে পারে, অনুভূতির ব্যাপারে। যদিও অনুভুতির মধ্যে জাদুকরী বিদ্যার কিছু নেই। তবে এই অনুভূতি আমাদের সিদ্ধান্ত তৈরিতে কম বেশী ভাল একটি উপায়। কিন্তু আমাদের অনুভূতিকে বাইরের কোন সিস্টেম কখনো কিছু বুঝতে পারে না। যতটা আমরা বুঝতে পারি। হোক সেটা আমাদের গীর্জা বা সোভিয়েত আমলের কেজিবি গোয়েন্দা সংস্থা। যেটি আমার ওপর প্রত্যেক মিনিটে নজরদারি রাখতে পারে। কেননা, চার্চ-কেজিবির সেই জৈব-রাসায়নিক জ্ঞান এবং গাণিতিক বুঝ নেই। যেগুলো আমাদের অনুভুতি-আকাংখাকে নানাভাবে আকার দেয়। তাই মানবতাবাদ যখন বলে “রিদয়ের কথা শোনো”, ব্যাপারটা ততটা গোলমেলে নয়। যদি আপনাকে বলা হয়। ‘হয় বাইবেলের কথা শোনো, না হয় রিদয়ের’। তখন রিদয়ের কথা শোনাটাই ঢের ভাল ছিল। কারণ বাইবেল কিছু প্রাচীন পাদ্রীদের মতামত-একদেশদর্শী বক্তব্যকে প্রতিধ্বনিত করছে। আর অন্যদিকে আপনার অনুভূতি হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হওয়া জ্ঞানকে প্রতিফলিত করছে। এবং এই অনুভূতি অনেক প্রাকৃতিক পছন্দের (natural selection) এর মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত টিকে আছে।
যাই হোক, চার্চ বা কেজিবি গোয়েন্দা সংস্থা নিজেরা আমাদের অনুভূতি বুঝতে অক্ষম হলেও তারা এখন গুগল-ফেইসবুককে এই কাজে পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আজ মানবতাবাদ তার বাস্তব সুবিধাগুলো হারাতে বসেছে। আমরা এখন দুটি বৈজ্ঞানিক ঢেউয়ের মোহনায় এসে পড়েছি। একদিকে, জীববিজ্ঞানীরা মনুষ্য দেহ বিশেষ করে মস্তিস্ক এবং অনুভূতির নানা রহস্য উন্মোচন করছেন। অন্যদিকে, প্রযুক্তিবিদরা অবারিত তথ্য উপাত্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়াকরণের শক্তি-অর্জনের সুযোগ দিচ্ছে। যখন এই দুটি বৈজ্ঞানিক দিককে একসাথে করবেন। আপনি একটি নতুন সিস্টেম অর্জন করতে পারবেন। যেটা আপনার আবেগ-অনুভূতিকে কেবল মনিটরিং নয়, খোদ আপনার চেয়ে বেশি বুঝতেও সক্ষম হবে। যখন এই তথ্য ভাণ্ডারের সিস্টেমটা আপনার মনকে আপনার চেয়ে বেশি বুঝতে পারবে। তখন আপনাকে শাসন করবার সকল ক্ষমতা এই গাণিতিক সমীকরণ দখল করে নেবে। হয়ত এই তথ্য ভাণ্ডার সেই আলোচিত ‘বিগ ব্রাদারের’ নতুন বাহন হিসেবেও কাজ করবে।
যদিও চিকিৎসাশাস্ত্রে ইতোমধ্যে এই দখলদারিত্ব শুরু হয়ে গেছে। এখন আপনি কেমন চিকিৎসা নেবেন তা আপনার অনুভূতি, আপনার সুস্থ্যতা-অসুস্থ্যতা অথবা আপনার চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে না। বরং কিছু হিসেব-নিকেশ এই দায়িত্ব পালন করে যা কিনা আপনাকে আপনার চেয়ে ভাল চেনে। এঞ্জেলিনা জোলির একটি মেডিকেল-কেইস এই ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হতে পারে। ২০১৩ সালে জোলি একটি জেনেটিক টেস্ট করিয়ে জানতে পারেন যে, তার শরীরে BRCA1 নামের জিনের বিপজ্জনক পরিবর্তন হচ্ছে। তথ্য-উপাত্তমতে, এই ধরনের জিনবাহী যেকোন নারীর স্তন ক্যন্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৮৭ শতাংশ। যদিও জোলি ক্যান্সার-সংক্রান্ত কোন সমস্যাই ছিল না। তবুও তিনি এই রোগ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য চিকিৎসা নিলেন, এবং তিনি তার স্তন কর্তন করলেন। তিনি কিন্তু তার আগে সামান্য অসুস্থতা বোধও করেননি, তবুও তিনি চোখ বুঝে এই তথ্য-উপাত্তে “ঈমান” এনেছিলেন। তাই এই গাণিতিক হিসাব আমাদের বলে, “যদিও কোন সমস্যা তুমি টের পাচ্ছ না, তবুও তোমার ডিএনএতে টাইম বোমার টিকটিক আওয়াজ টের পাচ্ছ, তাই যা করার আগে ভাগেই করো, এখনই”।
যেটি এই চিকিৎসা-ঔষধশাস্ত্রে ঘটেছে। সেটি এখন সবজায়গাতেই কম বেশী হচ্ছে। এটি যদিও শুরু হয় খুব হালকা ইস্যু নিয়ে। যেমন: বই পছন্দ করা এবং কেনার ব্যাপারে। একজন মানবতাবাদী কিভাবে বই কিনবে? সে একটি বইয়ের দোকানে যাবে। বুক-শেলফের অলিগলিতে হাটবে। একটা বই নিয়ে তার কিছু লাইন পড়বে। এভাবে চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন বই তার অনুভূতির সাথে মিলে যায়। আর অন্যদিকে এই তথ্যবাদে বিশ্বাসীরা ব্যবহার করবে এমাজনকে (amazon)। আমি যখন অনলাইন এমাজনে ঢুকি, একটি মেসেজ আগে ভাগে আসে যে, “আমি জানি তুমি কি কি বই খুব ভালবাসো পড়তে, তোমার মত চয়েজের আরো অনেকে এই নতুন বইগুলো (বই এর তালিকা) পছন্দ করছে”।
এটাতো কেবল মাত্র শুরু। এমাজন কিন্ডেল (Kindle) এর মতো যেসকল যন্ত্র ক্ষণে ক্ষণে আমাদের তথ্য নিয়ে যাচ্ছে যে, আমরা কী পড়ছি। কিন্ডেল এও পর্যন্ত বুঝতে পারে, আমরা বইয়ের কোন অংশটুকু দ্রুত পড়েছি। আর কোন অংশটুকু ধীরে। কত পৃষ্ঠায় এসে একটি বিশ্রাম নিয়েছি। এমনকি কোন লাইনগুলোবাদ দিয়েছি। তার খবরটিও কিন্ডেল জানে। যদি কিন্ডেলগুলোতে চেহারা বুঝে ফেলার ব্যবস্থা এবং বায়োমেট্রিক সেন্সর থাকত। তাহলে এটি বের করতে পারত কিভাবে কোন লাইন পড়ে আমাদের হার্ট-বিট বেড়ে গেছে। কিংবা রক্তচাপ উঠানামা করেছে। এটিও বের করতে পারত কোন বই আমাদের হাসিয়েছে। আর কোন বই কাঁদিয়েছে আমাদের। কিংবা রাগিয়েছে বড্ড। খুব জলদিই এইসময় আসবে। যখন আপনি বই পড়বেন। বইও সাথে সাথে আপনাকে পড়ে নিবে। আপনি হয়ত ভুলে যাবেন আপনি কি বই পড়েছিলেন। কিন্তু কম্পিউটার তো কখনো ভুলবে না। ফলে আপনার পাঠ-বিষয়ক তথ্যগুলোকে ব্যবহার করে এমাজন আপনার বই পছন্দ করে দিতে পারবে। যেটা খুব অদ্ভুতভাবে মিলেও যাবে। এমাজনকেও এই তথ্যগুলো জানান দিবে। আপনি কে এবং আপনার আবেগের কেন্দ্র কোথায় কোথায় আছে।
এসবের একটি যৌক্তিক উপসংহারও পাবেন। একসময়ে মানুষ হয়ত তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যেমন ধরা যাক, তার বিবাহের সিদ্ধান্তকে এই তথ্যভিত্তিক সমীকরণের হাতে ছেড়ে দিবে। আগের দিনে মধ্যযুগের ইউরোপে, পাদ্রী এবং পিতামাতাই কেবল আপনার সঙ্গী নির্বাচনের কাজটি করতেন। এই তথ্যভিত্তিক সমাজে এই মহান দায়িত্ব হয়ত আপনি গুগলকে দিতেন। বলতেন, “দেখুন গুগল বাবা, শাকের আর বাকের দুইজনই আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমিও দুজনকে পছন্দ করি। কিন্তু দুজন আবার দু’রকম। ফলে আমার জন্যে তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একজনকে পছন্দ করা খুব কঠিন। আপনি তো সবই জানেন, আপনিই বলে দেন এখন আমি করব?”
উত্তরে গুগল হয়ত গম্ভীর গলায় বলবে, “দেখো মা বুবলী, তোমাকে সেই জন্মের পর থেকে দেখছি। আমি তোমার চালাচালি করা সকল ই-মেইল পড়েছি, তোমার সকল ফোনকলের রেকর্ড ও আমার কাছে আছে, তোমার প্রিয় সিনেমা থেকে তোমার ডিএনএ এমনকি তোমার রিদয়ের পুরো বায়োমেট্রিক-ইতিহাস আমি জানি। তুমি কোথায় কবে শাকের আর বাকের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলে সেগুলোর দিন-তারিখ-সময়সহ যেমন জানি। তেমনি আমার কাছে আছে তখনকার তোমার প্রতি মুহুর্তের রিদয়ের স্পন্দন, রক্তচাপ এমনকি তোমার তখনকার শরীরের স্যুগার লেভেল পর্যন্ত জানা আছে আমার। ফলে শাকের-বাকেরকে তুমি যেভাবে চেনো। আমিও ঠিক সেভাবেই চিনি। একই রকমভাবে চিনি। তাই আমি বলি শোন, আমার কাছে আজ অব্দি যত তথ্য-সমীকরণ আর সমগ্র বিশ্বের কয়েক মিলিয়ন প্রেমের সম্পর্কের ব্যাপারে যে তথ্য আছে সেসব থেকে বলি। শাকেরকে বিয়ে করলে তোমার সুখী হবার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ”। (লেখক এখানে ইংরেজি নামের উদাহরণ দিয়েছিলেন, মূলবক্তব্য ঠিক রেখে পাঠকের সুবিধার জন্য পরিচিত বাংলানাম উল্লেখ করা হল)
“আর শোন হে বালিকা, আমি এও জানি আমার এই পরামর্শ তোমার মনঃপূত হয়নি। কারণ শাকের অনেক বেশি সুদর্শন এবং জানি তুমি বাহ্যিক সৌন্দর্য্যকে প্রাধান্য বেশি দাও। তাই তুমি চাও আমি যেন শাকেরের নামটাই বলি। হ্যা, এটা ঠিক যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু তুমি যতটা ভাবো ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু, তুমি হয়ত জানো না। তোমার জৈব-রাসায়নিক সমীকরণ যেটি আসলে দশ হাজার বছর পুরানো আফ্রিকান তৃণভূমির অঞ্চল থেকে বিবর্তিত হয়েছে। সেটি তার সঙ্গী পছন্দের ক্ষেত্রে বাহ্যিক-সৌন্দর্য্যকে ৩৫ শতাংশ বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু আমার সমীকরণ নানা তথ্য এবং গবেষণাসমেত তোমার চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। তাই আমার হিসেব বলে, একটি সফল প্রেমের ক্ষেত্রে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যকে ১৪ শতাংশের বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত না। তাই অনেক বেশি স্মার্ট-সুদর্শন হলেও তুমি বাকেরকে বিবাহ করলে খুব সুখী হবে”।
হ্যা! এটা ঠিক যে গুগল হয়ত উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ সফল হবে না। হওয়ার দরকারই বা কি! একজন মানুষের পছন্দের চেয়ে গুগলের পছন্দ বেশী ঠিক হলেই তো হল। এটি করা খুব কঠিন না। কেননা বেশিরভাগ মানুষ নিজেদেরকে কখনো আবিস্কার করতে পারে না। এবং এরাই নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে যেয়ে বিরাট বিরাট ভুল করে।
এই তথ্যভিত্তিক বিশ্বদৃষ্টি রাজনীতিক-ব্যবসায়ী এবং সাধারণ ভোক্তাদের ক্ষেত্রে খুব আকর্ষণীয় হয়েছে আজকাল। কেননা এটি বিশাল বিশাল প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন শক্তি প্রকাশের আয়োজন করে। ফলে নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করে স্বাধীন চিন্তা করা বনাম তথ্যভিত্তিক কার্যকরী চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ নিজেদের গোপনীয়তা নষ্ট করে নিজের জন্যে ভাল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে।
এই তথ্যবাদ যদি কোনভাবে ভুলও প্রমানিত হয়, এটি তারপরও বিশ্ব-জয় করবে। এই দুনিয়াতে এমন আরো অনেক আইডিয়া অনেকদিন টিকে ছিল। যেগুলো প্রকাশ্য-ভুলে ভরপুর বলে আজ আমরা জানি। তাই খৃষ্টীয়বাদ অথবা সমাজতন্ত্র যদি এখনো টিকে থাকতে পারে, এই তথ্যবাদ কি দোষ করেছে
জ্ঞানী-বুদ্ধিজীবিদের জন্যে এই তথ্যবাদ সেই কাঙ্ক্ষিত পবিত্র বস্তু দান করতে পারে। যার মাধ্যমে আমরা সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যেমন, সঙ্গীতবিজ্ঞান থেকে অর্থনীতি হয়ে জীববিজ্ঞানের সকল তথ্যকে একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট একক-তত্ত্বে নিয়ে আসতে পারি। তখন মমতাজের গান “মরার কোকিল”, স্টক এক্সচেঞ্জ এর আকাশ-কুসুম কল্পনার গ্রাফ কিংবা ভাইরাস জ্বর এই তিনটি ব্যাপার কেবলই তিনটি তথ্যের প্রবাহ হয়ে যাবে। যেটিকে আবার কিছু সাধারণ কনসেপ্ট এবং যন্ত্র দিয়ে একই উপায়ে বিশ্লেষণ করা যাবে। এটা খুব অসাধারণ আইডিয়া হবে বুঝাই যাচ্ছে। এটা সব দেশের সব বিজ্ঞানীদের একটা সাধারণ ভাষা দিতে পারবে। তাদের মধ্যে কার্যকরী যোগসূত্র তৈরি করতে পারবে। এমনকি নানা বিষয়ে নানা চিন্তা-আইডিয়া তারা সহজেই নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করতে পারবে।
হ্যা, এটা ঠিক যে বিশ্বকাঁপানো যেকোন আইডিয়ার মত এই তথ্যবাদের আইডিয়াও জীবনে নানা ঝক্কি-ঝামেলা বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে, তথ্যবাদ মানুষের কুখ্যাত “অন্তরের কঠিন সমস্যা”র কোন যুতসই উত্তর বের করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত আমরা হয়ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মনকে ব্যাখ্যা করার মত জায়গায় পৌছাইনি। কেন বিলিয়নের বেশি নিউরন একটি আরেকটিকে একেবারে নির্দিষ্ট একটি সিগন্যাল দেয়। যখন মানুষের রিদয়ে ভালবাসা, ভয় কিংবা ক্রোধ জাগে? এগুলো আমরা এখনো জানি না।
এই তথ্যবাদ যদি কোনভাবে ভুলও প্রমানিত হয়। এটি তারপরও বিশ্ব-জয় করবে। এই দুনিয়াতে এমন আরো অনেক আইডিয়া অনেকদিন টিকে ছিল। যেগুলো প্রকাশ্য-ভুলে ভরপুর বলে আজ আমরা জানি। তাই খৃষ্টীয়বাদ অথবা সমাজতন্ত্র যদি এখনো টিকে থাকতে পারে, এই তথ্যবাদ কি দোষ করেছে তাহলে! এর উপকারিতা বরং আরো বেশি। কেননা এটি জীবনের সকল ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে খুব দ্রুত। হয়ত সকল চিন্তার একত্রিকরণের উদ্দেশ্যে করা গেলে এই থিওরি। হয়ত আমাদের চলতি বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দী মতবাদ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।
আপনার যদি এই বাস্তবতা পছন্দ না হয়। আপনি যদি এইসব সমীকরণের বাইরে জীবন গড়তে চান। তবে পরামর্শ একটিঃ “নিজেকে জানুন”। যতক্ষণ নিজের ওপর বিশ্বাস-ভরসা বেশি করবেন। এইসকল তথ্য-উপাত্তে কম। আপনার পছন্দ যেকোন প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে এবং নিজের ওপর নিজের কতৃত্ব কিছুটা হলেও টিকে থাকবে। যদিও এই তথ্য-উপাত্ত ওইসব মানুষকে দখল করে ফেলে। যারা নিজেদের চিনতে ব্যর্থ হয়।