যে কারণে আমরা আকাশের দিকে তাকাই

যে কারণে আমরা আকাশের দিকে তাকাই

উমবার্তো ইকো’র মৃত্যু শুধু একটা বিরাট শোকবার্তা হিশেবেই যে হাজির হয়েছে তাই নয়—একই সাথে সমস্যা আকারেও হাজির হয়েছে। প্রথম সমস্যা ইকো’র পরিচয় নিয়া। অবশ্যই একজন লেখকের পরিচয় উনার কাজের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়। কিন্তু ইকো’র কাজের এরিয়া এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে তাঁর পরিচয় খোঁজার পরে যেই প্রশ্নটা মাথায় আসলো তা হলো, তিনি আসলে কী নন? ইকো এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার পরিচয় সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। ফলে বিশেষভাবে তার পরিচয় বের করতে চাওয়া অনেকের জন্যই বিরক্তির কারণ হয়েছে। এই ঘটনা দুনিয়ার খুব কম লেখকের ক্ষেত্রেই ঘটে। কেউ কেউ বলছেন, ইকো’র অর্জন সত্যিকার অর্থেই যুগান্তরকারী—এটা সবাই মানছেন, কিন্তু সেই অর্জনগুলো মানুষ ঠিকঠাক মতো এখনও বুঝতে পারছেন না। ফলে, আমি কিছু বিষয় কেবল টানা বলে যাব। উদ্দেশ্য হবে, আমরা যেন তাঁকে ‘পাঠ’ করতে উৎসাহিত হই। তার কাজকে বুঝতে মেহনত করি।

যদিও ইকো ঔপন্যাসিক হিশেবে পরিচিত, কিন্তু তার নিজের ভাষ্য হলো, ‘আমি একজন দার্শনিক; কেবল সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেই আমি উপন্যাস লিখি’। এক সাক্ষাৎকারে ইকোকে প্রশ্ন করা হয়, আপনার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য নেইম অব রোজ’ পুরোটা পড়ছেন এমন পাঠক খুব বেশি নাই। তারপরেও এটা এত বিখ্যাত হলো—আপনার কী মনে হয়’?

ইকো’র সোজা জবাব ছিল, এটা পুরোটা না পড়া খুবই সম্ভব। ল্যাটিন উদ্ধৃতিতে ভরা এই উপন্যাস পাঠ খুব আরামদায়ক কাজ না। আর সবই যে পুরা পড়া হয় এমনও না। আমাদের এখানেও ইকোকে নিয়ে বিশেষ করে এই উপন্যাসটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কিছু কিছু আলাপ-আলোচনা শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল—কিছু অংশ অনুবাদ করেছেন জিএইচ হাবীব। কিন্তু এর কোনও পাঠ বা পর্যালোচনা চোখে পড়েনি। যা হোক, ইকো মারা যাওয়ার পরে বিখ্যাত কাগজগুলো সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে বেশ কিছু হাস্যকর কাজ করেছে। ইকোর কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এরিয়া হল সেমিওটিকস। যারা সংবাদ পরিবেশন করেছে, এরা প্রায় কেউই জানেন না সেমিওটিকস জিনিসটা কী! যেমন, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাদের শ্রদ্ধাভাষ্যে জানিয়েছেন, সেমিওটিকস হলো, একটা রহস্যময় পরিমণ্ডল “arcane field”। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, এটা হল, the study of signs, চিহ্নবিদ্যা যেখানে প্রতীক ও গোপন বার্তা থাকে। গার্ডিয়ান লিখেছে, “semiotics is an abstruse branch of literary theory”, মানে, এটা হল সাহিত্যের একটি বিমূর্ত শাখা। এই হল বিশ্ব-মিডিয়ার সংবাদের ধরণ। এই বিষয়ে পরে ফিরছি। এর আগে ইকো’র পরিচয়ের সমস্যাটা নিয়ে কিছু কথা বলে ফেলি।

 

‘দ্য নেইম অব দি ইকো’:

এই শিরোনামে, দ্য লাইফ ইন দ্য রাইটিং-এর লেখক (Masturah Alatas) মাসতুরাহ অ্যালাটাস একটি লেখা লিখেছেন (নিউএইজ, ২৪ ফেব্রয়ারি ২০১৬ থেকে পড়েছি)।

ইকো একজন দার্শনিক, ইতিহাসবিদ এবং পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল—যিনি আবার একজন অধ্যাপকও। লিখেছেন বাচ্চাদের বই। এমন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে তিনি প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেন নি। তিনি নিয়মিত কলামও লিখতেন। এবং এইসব কাজের কোনটাই দায়সারা গোছের ছিল না। তিনি যে বিষয়েই কলম ধরেছেন সেইটাই ছিল একটা জ্ঞানগত নয়া আবিষ্কারের অভিযান। এমন একজন লেখককে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলে আলোচনা করলে তাঁর পরিচয়ের অসম্মানই করা হয় বলে অ্যালাটাস মনে করেন। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে তিনি মারা যাওয়ার পরপরই মিডিয়াগুলো তাকে অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সেমিওটিসিয়ান, দার্শনিক এইসব বারোয়ারি পরিচয় ছেপে যাচ্ছিল। তখন অ্যালাটাস প্রস্তাব করেন যে, ইকোকে সিম্পল একজন লেখক বলে ডাকাটাই হবে সম্মানজনক। এমন একজন লেখক যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, ভার্সেটাইল বা বহুদিক বিচরণকারী। কারণ উনার মৃত্যু সংবাদ সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠ আর কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও ব্যাপক শোকের আবহ তৈরি করেছে। তথাকথিত সিরিয়াস পাঠকের বাইরেও একদম সাধারণ পাঠকরাও তাদের ফেসবুক ও টুইটারে মাতমের জোয়ার তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘটনাও বেশ বিরল। সব মিলিয়ে আমিও মনে করি অ্যালাটাস ঠিকই বলেছেন, নানান খণ্ড পরিচয়ের বাইরে যখন আমারা বলব তিনি একজন ‘লেখক’, তখন অাসলে অনেক কিছু বলা হয়া যাবে। এবার তিনি কী নিয়ে লিখেন, সেই লেখার জরুরত কতখানি সেটা বুঝবার জন্য আমরা পাঠে ফিরব।

ইকো যেহেতু প্রায় সব কিছু নিয়েই লিখেছেন, ফলে এক লেখায় এই বিপুল বিষয়ের পরিচয়ও দিতে পারব না। এই লেখায় যে দুটি বিষয় নিয়ে খুব বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং আমাদের এখানে কম আলোচিত সেই দুইটি বিষয় একটু সংক্ষেপে আলোচনা করব। এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য ইকো’র কোন কোন বিষয়গুলো পাঠ করা অনেক বেশি জুতসই তার একটা ইশারা দিয়া লেখা শেষ করব।

তিনি ব্যাখ্যামূলক বা ইন্টারপ্রিটেটিভ সিমিওটিকস-এর শুরু করেন।

সেমিওটিকস  হারমেনিউটিকস:

শুরুতে বলেছিলাম, সেমিওটিকসকে নিয়ে বিশ্ব-মিডিয়ার খবরে বেশ কৌতুককর ঘটনা ঘটেছে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশেও ইকোকে নিয়ে গুগল ঘেঁটে অনেক লেখা ছাপা হবে। নেইম-সিকার বা নামছাপা কাঙাল লেখকরা গদ্য লিখে সাংবাদপত্রের সাহিত্যপাতা ভরে ফেলবেন। সেটা তারা করুকগা এবং সেটা নিয়া আমার কোনো সমস্যা বা আপত্তি নাই। শুধু আফসোস যে, এগুলা কৌতুক হিশেবেও বিরক্তিকর হয় (কৌতুক আমার খুবই পছন্দ)। যা হোক, সেমিওটিকসকে বাংলায় সাধারণত চিহ্নবিদ্যা বলে অনুবাদ করা হয়। কিন্তু আসলে বিষয়টি তা নয়। বিষয়টি মূলত অর্থ উৎপাদন বিষয়ক বিদ্যাশাস্ত্র। চিহ্নবিদ্যা এর একটি অংশ মাত্র। এই অভিধাটি এসেছে গ্রিক σημειωτικός sēmeiōtikos, ইংরেজিতে “observant of signs” বলে। ফলে এটাকে হোলসেল চিহ্নবিদ্যা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না। এবং এটা শুধু ভাষাবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে আর অাবদ্ধ নাই। জন লক তার বই, An Essay Concerning Human Understanding এর ৪ নং কিতাবের ২১ নং চ্যাপ্টারে টার্মটি ব্যবহার করেন। এটা নিয়ে অনেক চিন্তক কাজ করেছেন। এই বিষয়ে ইকো’র কাজের দার্শনিক গুরুত্ব এত বেশি যে এটাকে ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে একটা বই লিখতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একো তাঁর বিখ্যাত বই,  A Theory of Semiotics এবং, The Name of the Roseএ বিষয়টি এমনভাবে ডিল করেছেন যা এর আগে করা হয়নি। এই বিষয়ে তার গুরুত্বগূর্ণ অবদানের একটা হলো ব্যাখ্যাশাস্ত্র, যাকে হারমেনিউটিকস বলা হয়, বাংলায় যাকে তাফসির (সেই ক্ষেত্রে তাফসিরের অর্থকে একটু প্রসারিত করে বলতে হবে এটা দৈব কিতাবের বাইরেও ব্যবহার করা যাবে) বলতে পারেন। এবং ইকো আইকনিসিজম ও আইকনিক সাইনের বা চিহ্নের ক্রিটিক করেন। ইকোর কাজকে এই বিষয়ে যে কারণে মাইলফলক হিশেবে দেখা হয় তা হল, তিনি ব্যাখ্যামূলক বা ইন্টারপ্রিটেটিভ সিমিওটিকস-এর শুরু করেন। যা এই শাখাকে নতুন এক শিখর স্পর্শ করতে পথ দেখিয়েছে। তিনি তাঁর উপন্যাসে সেমিওটিকসের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়ে উপন্যাসপাঠক তো বটেই, চিন্তকদেরও তাক লাগিয়ে দেন। কিভাবে চিহ্নের অর্থ তৈরি হয় এবং পাল্টাতে পারে তার ব্যবহারিক নজির স্থাপন করেন এই জনপ্রিয় মাধ্যমে। ফলে একটু খেয়াল করে পাঠ করলে আসলে ইকো নিজেকে কেন পার্টটাইম উপন্যাস-লেখক বলেন তা বুঝতে পারা যাবে। উপন্যাসে তিনি কেবলমাত্র কাহিনি ডিল করেন না—মূলত ডিল করেন আইডিয়া। সন্দেহ নাই যারা ভাষা সাহিত্য ও চিন্তার নানা বিষয় নিয়ে কাজ করবেন তাদের জন্য বিষয়টি ব্যাপকভাবে চমকপ্রদ।

বাংলাদেশে যেহেতু দেরিদার একটা পরিচিতি আছে, ফলে চিহ্নবিদ্যা বিষয়ে কথাবার্তা কমবেশি আমাদের কানে আসে। কিন্তু হারমেনিউটিকস বিষয়টি এখনও আমাদের এখানে আলোচনা করা হয় না। বিষয়টি অপেক্ষাকৃত নতুন। এই বিষয়ে ইকো’র বইগুলো হলো, La struttura assente (1968; literally: The Absent Structure), A Theory of Semiotics(1975), The Role of the Reader (1979), Semiotics and Philosophy of Language(1984), The Limits of Interpretation (1990), Kant and the Platypus (1997), and From the Tree to the Labyrinth: Historical Studies on the Sign and Interpretation(2014).

তো সেমিওটিকস বিষয়টি ইকো কিভাবে ডিল করেন? কান্ট অ্যান্ড দ্য প্লটিপাস বইটাতে প্রথম অধ্যায় তিনি শুরু করেন ‘ওন বিয়িং’ নামে। অর্থাৎ প্রথমে ‘আছে-ময়তা’ দিয়ে আলোচনা শুরু করেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি শুরু করেন, ‘সামথিং অ্যান্ড সেমিওটিকস’ নামে। বিয়িং-এর ধারণার সাথে সেমিওটিক-এর ধারণার দুনিয়া কাঁপানো আলোচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন মার্টিন হাইডেগার। তারপরেও ইকো এখানে এমন কিছু যোগ করেছেন যার ফলে সাম্প্রতিক সেমিওটিকস বিদ্যার পরিসরে উনার অবদানকে পাহাড়প্রমাণ গণ্য করা হয়। তিনি তর্ক তুলেন, কেন সেমিওটিক ও সামথিং-কে একসাথে আলোচনা করতে হবে। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান ভাষাকে দেখে এমন অবস্থায়, যখন ইতোমধ্যেই ভাষা একটা স্ট্রাকচার বা কাঠামোর মধ্যে হাজির হয়ে থাকে এবং ফাংশন করে। তিনি মনে করেন, গোটা সেমিওটিক বিদ্যার একটা বড় সমস্যা হলো, এটা এখনও দেখায় না যে, যখন আমরা কথা বলি তখন আসলে ঘটনাটা কী ঘটে? কী এমন বিষয় (সামথিং), যা ভাষাকাঠামোর আগেই হাজির থাকে, যার ফলে আমাদের কথা বলা সম্ভব হয়ে ওঠে। অস্তিত্বের কোন ভরসার পাটাতনের ভিতর থেকে কথার জন্ম হয়? তিনি মনে করেন, আমারা যে কথা বলি সে বিষয়টা যতটা না ভাষাতাত্বিক তার চেয়ে অনেক বেশি সত্তাতাত্ত্বিক, এমনকি মনস্তাত্ত্বিক। যার একটা বিরাট অংশ স্ট্রাকচার বা কাঠামোর বাইরে থাকে। এই যে অধরা একটা এলাকা আছে, এই দিকটি নিয়ে ইকো ব্যাপক কাজ করেছেন। এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে কখনই দেখা হয় না, থিং বা কোনো কিছুর থাকা জিনিসটা কী? কোনো কিছুর থাকার বিষয়টি যে ভাষাপূর্ব ব্যাপার তা কখনই দেখা হয় না। এই সমস্যার ভিতর দিয়ে তিনি আধুনিক হারমেনিউটিকস বা তাফসির-বিদ্যার দিকে মনোযোগী হন। লিখেন, The Limits of Interpretation (1990)। প্রসঙ্গত বলে নেই, হাইডেগারও এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এক্ট অব ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে হাইডেগারের ধারণাটা হলো, পর্যালোচনার ক্রিয়া আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। এটা কেবলমাত্র একটা মেথড বা পদ্ধতি মাত্র নয়। এটি এমন একটি ক্রিয়া যা আমাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না। কিন্তু ইকো এই অবিরাম ব্যাখ্যার জগতের একটা সীমাবদ্ধতা দেখতে পান। সত্যের সাথে, ভাষার সাথে ও অস্তিত্বের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে কী—ইকো নতুন ইনকোয়ারি শুরু করেন। হাইডেগারের কাজের চেয়ে তার কাজের ফোকাস আলাদা হয়, এটা আরও বোঝা যায় যখন তিনি “দ্য কোশ্চেনিং অব দ্য পয়েটস” নামের ছোট প্রবন্ধটা লিখেন। হাইডেগার যেখানে বিয়িং-এর সাথে কবিতার সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে কবিদের একটু মহিমান্বিতই করেন। সেখানে ইকো বলেন:

What do the poets reveal to us? It is not that they say Being, they are simply trying to emulate it. (Kant and the platypus: Eco,P-32, Vintage-200.)

তিনি মনে করেন, কবিরা বিয়িং বা আছে-ময়তাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন না। এরা সরলভাবে বিয়িং-এর নকল করে থাকেন। এবং তিনি মনে করেন, বিয়িং-এর ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে কবিরা এই বিয়িং বা আছে-ময়তা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে পারেন না—বরং যতটা বিয়িং নিজেই নিজের হাজিরা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। এইখানে হাইডেগারের চেয়ে তিনি ভিন্ন কথা বলেন (কখনও উল্টাও মনে হতে পারে)। সেমিওটিকস-এর এলাকায় এইসব জরুরি বিষয় নিয়ে পদ্ধতিগত আলোচনার এক বিশাল সাম্রাজ্য আছে। আশা করি আগ্রহী পাঠক এখান থেকে কেবলমাত্র কিছু রেফারেন্স পাবেন (বিস্তারিত বলতে পারলাম না—চটজলদি লেখার তাড়ায়)।

ব্যাখ্যা, অর্থ, বিয়িং, ভাষা—এইসব জটিল বিষয় নিয়ে এত সহজ করে এত সংক্ষেপে কেউ লিখতে পারে, তার নজির ইকোই দুনিয়াতে সাম্প্রতিক কালে স্থাপন করলেন।

এইসব জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনো ইচ্ছে এখানে ছিল না। তারপরও আবছা ধারণা ও ইকোকে একজন বেস্ট সেলার ঔপন্যাসিক হিশেবে পাঠের প্রবণতা যেন আমাদের মাথায় না ঢুকে যায় সেই দিকটা মাথায় রেখে একটু বলেই ফেললাম। যদিও আমি নিজেই এখনও এইসব বিষয় পাঠের মধ্যে আছি। নতুন নতুন জিনিস শিখতেছি প্রতিনিয়ত। জানি এইসব আলাপে অনেক পাঠকের বিরক্তি তৈয়ার হতে পারে। যা হোক, হারমেনিউটিকস বিষয়টি আমাদের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। মনে আছে, বিখ্যাত বই ক্ল্যাশ আব সিভিলাইজেশন বের হলে দুনিয়াতে ঝড় বয়ে যায়। তখন এর একটা জুতসই ক্রিটিক করেন এডওয়ার্ড সাইদ। তিনি বলেন, এইখানে কোনো সভ্যতার সংঘাত নাই। যা আছে তা হলো, ক্ল্যাশ অব ইন্টারপ্রিটেশন। এই ইন্টারপ্রিটেশনকে নানা দিক থেকে যে শাস্ত্রে পাঠ করে তার নামই ‘তাফসির শাস্ত্র’ বা ‘হারমেনিউটিকস’। কোনো ঘটনা বা কিতাবকে জানা বা বোঝার জন্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা, নতুন নতুন ব্যাখ্যা তৈরির চেষ্টা করা–এইসব বিষয় দুনিয়াতে নয়া না। কিন্তু পশ্চিমে এটাকে একটা শাস্ত্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনা বেশ নতুন। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়, জর্জ গাডামারের বিখ্যাত গ্রন্থ ট্রুথ অ্যান্ড মেথড। এই বইটাতে তিনি হারমেনিউটিকস-এর ইতিহাস, আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এরপর থেকেই বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্ব পেতে থাকে। ইকো মোটামুটি ১৯৬৭ সাল থেকে এইসব বিষয় নিয়ে সিরিয়াসলি লিখতে থাকেন। যদিও এই সব বিষয়ের সাথে তার নাম জোরের সাথে চাউর হতে বেশ সময় লেগেছে। তবে আরব অঞ্চলে এই বিষয়টির শুরু হয়েছে মধ্যযুগেরও আগে। বিশেষ করে ঐশী কিতাব ও নানা ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যার প্রয়োজনেই ভাষ্যশাস্ত্র অনেক আগে থেকেই চালু ছিল। ফলে সব সময় যে জ্ঞানের বিষয়গুলো পশ্চিম থেকেই আমদানি হয় এমন না। কিন্তু আধুনিক সময়ে  ইউরোপ-আমেরিকা মনোযোগের কেন্দ্রে থাকায় পাবলিক ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে জ্ঞান বুঝি পশ্চিমেই পয়দা হয় আর সারা দুনিয়ার মানুষ ডিম পাড়ে!

হারমেনিউটিকস- বর্ণনা, ব্যাখ্য ও অনুবাদের দার্শনিক দিক নিয়েও আলোচনা করে। এই বিষয়টি নিয়ে এত কথার কারণ হলো, ব্যাখ্যা বা বয়ানের ভিতর দিয়ে ক্ষমতাও তৈরি হয়। এর সাথে ইতিহাস ও রাজনীতির একটা শক্ত যোগ আছে। আর আমরা মানে বাংলাদেশের বাসিন্দারা এখন ব্যাখ্যার ভিকটিম বা শিকারে পরিণত হয়েছি। ফলে ইকো’র প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ছুতায় এই বিষয়ে যেন চিন্তামূলক আলোচনার একটা পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে আমাদের পোলাপাইন আগ্রহী হয়, তাই বিষয়টি নিয়া একটু খাপছাড়াভাবে হলেও বেশ কিছু শব্দ খরচা হয়ে গেল। পশ্চিমে হারমেনিউটিকসকে অ্যাক্ট অব ইন্টারপ্রিটেশন নামেও ডাকা হয়। সো বিষয়টি আমাদের জন্যও অতীব জরুরি।

ইকো বলেন, “উপন্যাস পড়ে যারা কান্দে এরা খুব হায়ার লেভেলের স্টুপিড।”

বাংলাদেশ থেকে ইকো পাঠের তাগিদ:

কিছু কিছু লেখক নিজেই একটা ফেনোমেনা বা ঘটনা হয়ে ওঠে। বাজার-সংস্কৃতির যুগে নীলছবির তারকা ও লেখকের জনপ্রিয়তা—দুইটাই ব্যাপকভাবে উৎপাদন করার জন্য মিডিয়ার কসরত চোখে পড়ার মতো। ইকো সেই দিক থেকে একটু ব্যতিক্রম এই জন্য যে, তিনি জনপ্রিয় মিডিয়াতে যেই পরিচয়ে হাজির হয়েছেন তার কাজের সাথে এর সম্পর্ক খুব সামান্য। এইটা আপনারা ইকো পাঠ করতে গেলেই বুঝবেন। মিডিয়াতে যখন তারে ঐতিহাসিক রহস্য-উপন্যাসের লেখক হিশেবে পরিচয় করায় দেওয়া হয় তখন এর চেয়ে মিসরিপ্রেজেন্টশন আর কী হতে পারে? তিনি রহস্য ও ইতিহাস সবই ব্যবহার করেন, কিন্তু উপন্যাসের যে দার্শনিক বিস্তার ঘটান বা যেভাবে উপন্যাসকে দার্শনিক সমস্যার ব্যবহারিক ময়দান হিশেবে ব্যবহার করেন তা উচ্চারিত হতে শুনবেন না।

যা হোক ইকোকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকগুলো সমস্যার একটা হলো, ব্যক্তিগত নানান বিষয় চলে আসার কথা। বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর পরে যখন এই ধরনের চটজলদি লেখা লিখতে হয় তখন কিছুটা আত্ম-কাসুন্দি ঘাঁটা হয়ে যায়। আমিও ভাবছিলাম এটাই করব। কিন্তু কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রিয় লেখক হামিদ দাবাসির একটা লেখা পড়ে সেই ইচ্ছে চলে গেল। হামিদ সাহেবের লেখার শিরোনাম—ইকো মৃত্যু বরণ করেছেন: ইকো দীর্ঘজীবন পাক। আল-জাজিরাতে লেখাটা ছাপা হয়েছে। সেই লেখায় তিনি ইকো’র সাথে তার সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত কাসুন্দির বয়ান দিয়ে মূলত শোকের মাতম করেছেন। সেখানে এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘এটা কোনো লেখা হলো? এটা তো লেখকের ব্যক্তিগত আত্মবিকারের বা নারসিস্টিক মনের একটা জঘন্য ভাষ্য’। এই মন্তব্য পড়ে নিজে একটু সতর্ক হয়েছি। তারপরেও পশ্চিমা লেখকদের নিয়ে কেন এত সময় ও শব্দ ব্যয় করতে হচ্ছে তার কিছু কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাকে নিজের পাঠ নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে। এই পর্বে ঢোকার আগে পাঠকদের কাছ থেকে মাফ চেয়ে শুরু করছি। এইটা এ জন্যই শেয়ার করছি যে, হয়তো অনেকে এর চেয়ে ভিন্ন বিষয় এই লেখকের মধ্যে খুঁজে পাবেন এবং শেয়ার করবেন। এক সাক্ষাৎকারে ইকোকে তরুণ লেখকদের জন্য কিছু বলার অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, নিজেরে খুব সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নাই। সব সময় বই করার প্রেসার ফিল না করে লেখার মধ্যে আনন্দময় আবিষ্কারের দিকে যেন আমরা বেশি মনোযোগী হই। এ কথাটা বেশ পছন্দ হইছে। একবার ইস্তামবুলে একটা আলোচনা সভায় তিনি বিখ্যাত লেখক ওরহান পামুকের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। তখন উপন্যাস পাঠ নিয়ে বেশ মজার আলোচনা জমে ওঠে। কথাটা এই জন্যই বলছি, কারণ বাংলাদেশে একদল লেখক আছেন যারা মনে করে, পাঠককে কান্দাইতে পারলেই লেখা সার্থক হইল। ইকো বলেন, উপন্যাস পড়ে যারা কান্দে এরা খুব হায়ার লেভেলের স্টুপিড। আর লেখক যখন ফিকশন লিখবেন তখন বারবার সত্যটা মনে করিয়ে দিতে হবে যে, তিনি একটা গল্প পড়ছেন, এটা বাস্তব না। আর এটা করতে পারলে পাঠক কানবেন না। কারণ তিনি বুঝতে পারবেন, এটা ফিকশনে ঘটছে। ফলে লেখককে সৎ থাকার দরকার আছে। যা হোক, ইকো আমাদের সময়ের খুব দরকারি চিন্তক। জীবন, সাহিত্য ও প্রায় সব বিষয়ের ভিতর তিনি যে অবিরাম ভ্রমণ করেছেন তা ধীরে ধীরে আমরা পাঠ করতে চেষ্টা করব। আর আমার পাঠকে অশিক্ষিতলোকের পাঠচেষ্টা হিশেবে ধরিয়ে দিয়ে উপকৃত করবেন পাঠকরা, এটাও আশা করছি। ফলে এই ‘আমি’ ব্যক্তির আমি না। সমষ্টির মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা একজনের ভাষ্য মাত্র।

ইকো কেন আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার একক কোনো কারণ নাই। নিশ্চয়ই তার কৌতুকপ্রিয় বয়ানের ভঙ্গি একটা বিষয়। কিন্তু আরও একটা দিক আছে, ইকো লেখা এত দ্রুত টাইমফ্রেম টপকায় যে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সে প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে চলে আসেন একই বাক্যের মধ্যে। এত ছোট অথচ এত ব্যাপক বিষয় নিয়ে ডিল করেন একই সাথে, টাশকি না খেয়ে উপায় থাকে না। তিনি এমন সহজ ও দৈনিন্দিন বিষয়ের সাথে এমন গূঢ় দার্শনিক যোগ তৈরি করেন, তখন মনে হয় চিন্তা করাটা প্রতিদিনের আহার-নিদ্রার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা কোনো বিশেষ সাংস্কৃতিক বা বুদ্ধিজীবী টাইপের দায়িত্ব না। এটা সত্তার নিজস্ব ডাক। এটা স্বাভাবিক। পড়তে পড়তে মনে হয় এত সহজ বিষয়ে এত গভীর তাৎপর্য, অথচ আমরা ফূর্তি নিয়ে বাঁচার জন্য বিজি হয়ে আছি। ইকো খুব ফানি ভঙ্গিতে লিখেন। বাট আপনি যখন এর মধ্যে চিন্তার লড়াইটা ধরতে পারবেন, নিজেকে একটু স্টুপিড মনে হতে পারে। কেন আমরা এত কম ভাবনা-চিন্তা করে বাঁচতে বা মরতে চাই? এমন প্রশ্ন জাগতে পারে। তার লেখার আরও একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি এত অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে এত জরুরি আইডিয়া ডিল করেন যার নজির দুনিয়াতে আর নাই। তার দার্শনিক লেখাও খুব মামুলি চালে এগিয়ে যায়। এই খেলার ভঙ্গিটা শিখবার দরকার আছে। তাইলে লেখক হিসেবে নিজের অহং-এর একটা ফয়সালা হতে পারে। এটা নিয়া বেশির ভাগ লেখক খুব নিপীড়িত থাকেন।

চিন্তা ও পাঠের আনন্দ—দুইটাই থাকে ইকোর লেখায়। এগুলো অবশ্য সবারই জানা কথা। এর বাইরে বাংলাদেশে বসে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইকোকে পাঠের জরুরতও কিছু কম নাই।

বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা (বেশির ভাগই) এতে শর্ট টেম্পো ধরেন যে, বানায়া গল্প লিখতে পারলেও চিন্তা করতে গিয়ে হয় ষাঁড় নয় বাছুর হয়ে যায়। সাহিত্যকে মনে করে ব্যক্তিগত অহং ও অক্ষমের খ্যাতি লাভের উপায়। ফলে এর সাহিত্যও হয় সার্কাসের মতো। যতক্ষণ আলো ততক্ষণ নাচ। পরে খবর থাকে না। দল ও কতিপয় পুরস্কার এবং কিছু পোষ্য তোষামোদ ছাড়া একটুও আগাতে পারে না। সাহিত্য যে ভাবাবেগের জিনিস মাত্র না, এবং তরল গল্পলেখকও যে একই সাথে দুনিয়া কাঁপানো চিন্তক হতে পারেন এমন নজির আমাদের নাই। অবশ্য দুনিয়াতেও খুব এভেইলেবল না। আর এই বিরল ব্যক্তির একজন উমবার্তো ইকো।

‘রাষ্ট্র সবসময় শত্রু আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে।’

 

সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। দুনিয়াতে এত বড় চিন্তক আর বেশি নেই এখন। তার উপন্যাস দুইটার বেশি পড়ি নাই (দ্য নেইম অব দ্য রোজ, ফুকোস পেন্ডুলাম)। কিন্তু তার দার্শনিক রচনাবলির গুরুত্বপূর্ণ অনেক অংশই কোনো না কোনোভাবে পড়েছি, পড়ছি। এই বছর জানুয়ারিতে আমার বন্ধু বিখ্যাত ডকু-ফিকশন নির্মাতা নেফিসে ওজকাল লরেনজেন বাংলাদেশ সফরে আসার সময় আমার জন্য বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছিলেন সুদূর নেদারল্যান্ড থেকে। এর মধ্যে ইকোর তিনটা বইও ছিল।

১. ট্রাভেলস ইন হাইপার রিয়ালিটি
২. কান্ট অ্যান্ড দ্যা প্লাটিপাস
৩. ইনভেনটিং দ্যা এনিমি।

প্রথম বইটা গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নে ভরপুর। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ছি, যাতে হজমশক্তির উপর চাপ না পড়ে। কিন্তু পরের বইটা মনে হয় ইকোর সর্বশেষ ইংরেজি তর্জমা হওয়া ননফিকশন (২০১৩-তে ভিনটেজ থেকে বের হয়েছে)। এটা বেসিক্যালি কিছু ক্যাজুয়াল রাইটিং ও আলোচনার সংকলন। একজন দার্শনিক যখন খুচরা কথা-বার্তা কয়, তার ধরন ও বৈশিষ্ট্য দেখে অবাক হয়েছি। কত জটিল বিষয় খেলার ঢঙে বলে চলেন। এই বইটা আমার খুব প্রিয়। এইখান থেকে নানা কথা মাঝে মাঝে আমি কোট করি। যেমন তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্র সবসময় শত্রু আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে।’

আমাদের চেয়ে কে আর এইটা এত ভাল বোঝে। আমাদের রাষ্ট্র এই শত্রু আবিষ্কারের প্রতিভার উপরই টিকে থাকে। টিকে আছে। তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতার বৈধতার জন্য শত্রুকে যে যত কুৎসিতভাবে উপস্থাপন করতে পারে সে তত বেশি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে।’ এই সত্যও ভারতবর্ষের মানুষ অনেক ভালোই জানে।

এই বইটা বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে ভালো কাজে লাগে। এবং তিনি প্রশ্ন রাখেন, শত্রু ছাড়া একটা দেশ কেমনে সম্ভব হতে পারে? এই প্রশ্নটা সারা দুনিয়ার জন্য খুবই রেলিভেন্ট প্রশ্ন। আমরা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রজনিত সংকটের কালে বাস করছি।

যা হোক, ইকো সারা দুনিয়ার চিন্তা পরিমণ্ডলকে বেশ ব্যাপকভাবে টাচ করেছেন, করে আছেন। কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে যে কাজ করেছেন—সত্যিই অবাক হতে হয়। হায়, তিনি আর আমাদের মাঝে নেই! ৮৪ বছর বয়সে দেহ ত্যাগ করলেন। কিন্তু আমরা তো জানি, প্রকৃত চিন্তকের মৃত্যু নেই। জাস্ট তার আর কোনো নতুন লেখা পাব না। হে মহান দার্শনিক, আপনার জন্য গভীর শোক ও ভালোবাসা প্রকাশ করছি।

তার কাজের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তিনি চিন্তা ও কল্পনাকে উস্কে দেন। আমরা সবাই বিষয়টি ফিল করি, কিন্তু সব সময় বলি না, তিনি বলে ওঠেন। তার আর একটি বিখ্যাত লেখা হলো ‘উর-ফ্যাসিজম’। ছোট অথচ কী পরিমাণ গুরুত্ব যে ধরে লেখাটি তা না পড়লে বুঝিয়ে বলা মুশকিল। ফ্যাসিবাদ নিয়ে আমরা যা জানি তার অনেক অনুমানই পাল্টে যায় ইকোর এই লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে। ইকো এইখানে যেমন বলেন, “In my country today there are those who are saying that the myth of the Resistance was a Communist lie. It is true that the Communists exploited the Resistance as if it were their personal property.”

প্রতিরোধের মধ্যে একটা বামপন্থি মিথ্যাচার থাকে। এবং এটা সত্য যে বামপন্থিরা এই প্রতিরোধ-পর্বকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন। যারা বাংলাদেশের বামপন্থা নিয়ে খোঁজখবর রাখেন তারা ভালো করেই জানেন এটা কতখানি সত্যি। আর এই অক্ষমতার জন্য এরা কিভাবে ফ্যাসিবাদের শরীকে পরিণত হন। এটা নিয়ে আলাদা লিখবার বাসনা আছে। ইকো এত বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন যে তার একটা প্রাথমিক ধারণার জন্য একটা লেখা যথেষ্ট নয়। এই বিশাল পাহাড় এক দিক থেকে দেখা সম্ভব নয়। নানা দিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে হয়। তার চিন্তা দুনিয়ার মানুষকে অনেকদিন ভাবনা-চিন্তা করতে বাধ্য করবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। আর এই ভাবাভাবির দিকে নিজেদের ধাবিত করার জন্য বাংলাদেশ থেকে আমাদের পাঠপ্রস্তুতির একটা তাগিদ দিতে চেষ্টা করা ছাড়া এখানে আর কিছু বলতে পারছি না। আর এই পাঠপ্রচেষ্টা জোরালো হলে আমাদের মধ্যে ইকো’র ক্রিটিকও তৈরি হবে। তবে পাঠক হিশেবে ইকো’র প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়েছে এই কারণে যে, তিনি ভারত-পাকিস্তানের বিষয় নিয়েও ভেবেছেন। মালয়েশিয়ার উপর বই লিখেছেন। এটা হয়তো উপন্যাস লেখার মতো খেলার প্রতিভা থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে। বাট চিন্তক হিশেবে ইকো শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান সাবজেক্টিভ মোটিভের বাইরে যেতে পারেন নাই সবসময়। যদিও আরব নিয়ে তিনি লিখেছেন। কিন্তু পশ্চিমা চিন্তকদের কমন যে গ্রিকো-রোমান ছক, তার বাইরে তিনি যান নাই। বাট এটার জন্য তার চিন্তার গুরুত্ব কমে নাই। এটা হয়তো ইউরোপের সমস্যা। কিন্তু পাঠের সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। গদগদ ভাব বেশি হইলে সমস্যাও আছে। আমরা মনে করি চিন্তার কোনো দেশ-কাল নাই। সেই দিক থেকে ইকোকে আমাদের মতো করে রিডিং দিতে হবে। নিজেদের চিন্তার জমিন পরিষ্কার করার জন্যই ক্রিটিক্যাল হতে হবে। তার আগে একজন চিন্তককে কিভাবে পড়তে হয় তার তালিমটাও নিয়ে নিতে হবে। যাক, আর কথা না বাড়াই। মৃত্যু নিয়ে ইকো’র চিন্তটা এত আসাধারণ। পড়তে গিয়ে মনে হলো—আরে, আমরা এত আকাশের দিকে তাকাই অথচ এখনও তো খেয়াল করি নাই, কেন তাকাই?

ইকো লিখেন:

How does a person feel when looking at the sky? He thinks that he doesn’t have enough tongues to describe what he sees. Nevertheless, people have never stopping describing the sky, simply listing what they see… We have a limit, a very discouraging, humiliating limit: death. That’s why we like all the things that we assume have no limits and, therefore, no end. It’s a way of escaping thoughts about death. We like lists because we don’t want to die.

আমরা আকাশের দিকে তাকায়া অনেক সময় বিহ্বল হয়ে যাই। কিছু কইতে পারি না। কেবল একটা অনুভূতি হয়। কী অনুভূতি হয় তাও কইতে পারি না। তারপরেও আমরা নানাভাবে আকাশকে বর্ণনা করতে থাকি (এখানে যেমন ইকোকে বর্ননা করতে চাইলাম)। কিন্তু আসলে আমরা দেখি, আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে—সেইটা হলো মুত্যু। কিন্তু যখন আমরা এমন কোনো কিছু দেখি যেটার কোনো সীমা নাই তখন আমরা পুলকিত বোধ করি, মানে আমরা মৃত্যু থেকে পালাতে চাই। অসীমের দিকে যাইতে চাই। এইসব জিনিশ আমরা পছন্দ করি, কারণ আমরা মরতে চাই না। ফলে আমরা আকাশের দিকে তাকাই। আমরা এখন ইকো’র দিকে তাকাই। ইকো; তুমি আকাশ হয়ে যাও।

ঘটনা, উপাখ্যান ও ইতিহাস নিয়ে সংলাপ : ওরহান পামুক-উমবার্তো ইকো