পোকা দিয়ে পোকা দমনে অ্যালবার্ট কোয়েবেলের বিস্ময়কর সাফল্যের গল্প

পোকা দিয়ে পোকা দমনে অ্যালবার্ট কোয়েবেলের বিস্ময়কর সাফল্যের গল্প

ফসলের জন্য ক্ষতিকর এমন পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরেকটি পোকার জাতকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ রয়েছে যেগুলো দিয়ে ক্ষতিকর বালাই দমন সম্ভব। কিছু কিছু পোকা হয়ত সরাসরি আরেক পোকাকে খেয়ে বেঁচে থাকে অর্থাৎ শিকারি কীটপতঙ্গ গুলো ফসলের মাঠে ব্যবহার করা হয় বালাইনিয়ন্ত্রক হিসেবে।

insect-joban-1
এটি একটি শিকারি পোকা, সাধারণ নাম প্রেয়িং মেন্টিড, বৈজ্ঞানিক নাম Mantis religiosa

আবার কিছু কিছু পোকা আছে যারা সরাসরি শিকারী না কিন্তু অন্য জীবন্ত পোকার গায়ে ডিম পেড়ে দেয়, সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে বাসা বাঁধে ঐ জীবিত পোকার দেহে। বাচ্চা বড় হয় আর ধীরে ধীরে মারা যায় সেই পোকাটি যার গায়ে ডিম পাড়া হয়েছিল। এই ধরনের পোকাকে বলা হয় প্যারাসিটয়েড। বর্তমানে এই পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়। যাহোক এই পোকা দিয়ে পোকা দমন করার ইতিহাস নতুন নয়।

ইকনিউমন মাছি, এটি একটি প্যারাসিটয়েড। বৈজ্ঞানিক নাম Megarhyssa spp ছবি: ইইউগ্রাফ ডটকম।

চায়নারাই প্রথম এই ধরনের প্রাকৃতিক শত্রু দিয়ে পোকা দমন শুরু করে। যদিও সেটা এখনকার মত তেমন সুসংহত উপায়ে ছিল না। ৩য় শতকের দিকে চীনের ক্যান্টন প্রদেশে (বর্তমানে গোয়াংঝু) লেবু জাতীয় গাছের পোকা দমন করার জন্য এক ধরনের পিঁপড়া বিক্রি করা হতো। ইয়েমেনেও আনুমানিক ১২০০ সালের দিকে খেজুর গাছের পোকা দমন করার জন্য পিঁপড়ার ব্যবহারের উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে যে, বড় বড় পাহাড় থেকে পিঁপড়ার বাসা সমূলে নিয়ে এসে ঐ খেজুর গাছগুলোতে স্থাপন করা হতো। সম্ভবত ১২০০ সালের দিকেই প্রথম লেডি বার্ড বিটল নামের একটি পোকা প্রথম প্রাকৃতিক শত্রু হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৩০০ সাল থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ছিল এই খাতে সুসংহত গবেষণার প্রাক্কাল। ১৬০২ সালে এলড্রোভান্ডি নামের একজন কীটতত্ববিদ প্রথম দেখতে পান এক ধরনের প্রজাপতির ওপর Apantalese glomeratus নামক এক ধরনের প্যারাসিটয়েডের কোকুন রয়েছে। তারও প্রায় ১০০ বছর পরে ১৭০৬ সালে ভ্যালিসনিয়েরি নামের আরেকজন বিজ্ঞানী এই ধরনের প্যারাসিটয়েড সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। আজকাল যে ছারপোকা বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে কিংবা ছাত্রাবাসে আতংকের নাম, সে ছারপোকাকে সফলতার সাথে স্পাইনি শিল্ড বাগ নামক এক ধরনের পোকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এবং সেটি ১৭৭৬ সালে ইউরোপে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। ১৮০০ সালের দিকে চার্লস রবার্ট ডারউইনও পোকা দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে কথা বলেন। ১৮৫০ সাল পর্যন্ত এই ধরনের গবেষণাগুলো ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু এর পরপরই এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা আরও আগে থেকেই বলে আসছিলেন এই সম্ভাবনার কথা। কিন্তু তাদের দেশে তেমন কেউ গা করেননি। সমসাময়িক সময়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার। আমার লেখার পরের অংশটি শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠান এবং তার কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে লেখা। আবশ্যিকভাবেই সেখানে আসবে আজকের লেখার মধ্যমণি অ্যালবার্ট কোয়েবেলের কথা।

১৮৬০ সাল থেকেই আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বারবার বলে আসছিলেন ইউরোপের যে পোকাগুলো দমনের কাজে সফলভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে সেগুলোকে আমেরিকায় এনে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করতে। কংগ্রেসে বারবার এই ধরনের আবেদনকে তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেয়া হতো। ঐ সময়ে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের প্রধান ছিলেন সি.ভি. রিলে।

joban-reley
সি.ভি. রিলে, ইউএসডিএ’র সাবেক প্রধান। ছবি: বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল ডটইনফো।

 

বেনজামিন ওয়ালশ তখন দেনদরবার করছিলেন বিদেশি পোকা আমদানি করার জন্য। রিলে তখন ছিলেন মিসৌরিতে। রিলে সেখানে এমন একটি পোকার সন্ধান পান যেটি তাল গাছের একটি মারাত্মক পোকাকে দমন করতে পারে। ওয়ালশের অনুরোধে রিলে সেই উপকারি পোকাটি নিয়ে আসেন এবং আমেরিকার অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে দেন। ১৮৭৩ সালে রিলে Tyroglyphus phylloxerae নামক আরেকটি পোকাকে ফ্রান্সে আঙুর গাছের পোকা দমনের জন্য পাঠান কিন্তু তেমন সফলতা আসেনি সেবার। ততদিনে রিলে আমেরিকায় পোকা আমদানির ব্যাপার পাকা করে ফেলেছেন। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে পোকা দমনের উদ্দেশ্যে পোকা আমদানি করা হয় ১৮৮৩ সালে Apantalese glomeratus এর আমদানির মধ্য দিয়ে।

সময় সময় কিছু পোকা চাষীদের জন্য মারাত্মক আতংক হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৮ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়াতে এই ধরনের একটি আতংকের নাম ছিল কটনি কুশন স্কেল পোকা। ১৮৬৮ সালে প্রথম এর আক্রমণের কথা শোনা যায়, খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে এলাকা জুড়ে। ১৮৮৬ সালের দিকে এর এটি এতই প্রকটভাবে বিস্তার লাভ করে যে, সাইট্রাস কৃষকরা শুধুমাত্র এই একটি পোকার আক্রমণের জন্য পথে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
Apanteles glomeratus

 

সময় সময় কিছু পোকা চাষীদের জন্য মারাত্মক আতংক হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৮ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়াতে এই ধরনের একটি আতংকের নাম ছিল কটনি কুশন স্কেল পোকা। ১৮৬৮ সালে প্রথম এর আক্রমণের কথা শোনা যায়, খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে এলাকা জুড়ে। ১৮৮৬ সালের দিকে এর এটি এতই প্রকটভাবে বিস্তার লাভ করে যে, সাইট্রাস কৃষকরা শুধুমাত্র এই একটি পোকার আক্রমণের জন্য পথে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

joban-insects-4)
কটনি কুশন স্কেল

 

এই পোকাটি গাছের সাথে একেবারে আঠার মত লেগে থাকতো। চাষীরা পানি দিয়ে ধুয়ে দেখেছেন, এমনকি সায়ানাইড গ্যাস পর্যন্ত স্প্রে করেছিলেন গাছে, তেমন কোন সুফল আসেনি। লোকজন দলে দলে এসে ধর্ণা দিলো ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের প্রধান রিলের কাছে। রিলে এই স্পেশাল কাজের জন্য নিয়োগ দিলেন দুজন ব্যক্তিকে। একজন হলেন কনকুইলেট এবং আরেকজন কোয়েবেলে। বেতন ১০০ ডলার। ১৮৮৬ সালে কোয়েবেলে লস এঞ্জেলসে চলে গেলেন এই পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করতে। এদিকে ১৮৮৬ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান কীটতত্ববিদ ফ্রেজার ক্রফর্ড কটনি কুশন স্কেলের একটি প্যারাসিটয়েড আবিষ্কার করেন। Cryptochaetum iceryae যার বৈজ্ঞানিক নাম।

joban-insects-6
প্যারাসিটয়েড Cryptochaetum iceryae ছবি: উইকিস্পেসিস।

 

ফ্রেজার রিলেকে চিঠিতে এই পোকা সম্পর্কে লিখেন। দেরি না করে রিলেও কোয়েবেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে সাইট্রাস গ্রোয়ার্স এসোসিয়েশন অব ক্যালিফোর্নিয়া রিলেকে তাদের কনভেনশনে ডেকে এনে হাতজোড় করে অনুরোধ করেন কিছু একটা করার জন্য। রিলে হাত পাতলেন কংগ্রেসের কাছে কিছু অর্থ সাহায্যের জন্য। কোয়েবেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠাতে গেলে কিছু টাকার দরকার আছে। কংগ্রেসের মহাশয়রাতো হেসেই বাঁচেনা। পাগল নাকি একটা। একটা পোকা দিয়ে আবার আরেকটি পোকা মারা সম্ভব নাকি। তারা বলে দিলেন টাকা পয়সা দিতে পারবেননা। ১৮৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সেই চাষীরা মিলে জোগাড় করলেন ২০০০ ডলার, পুরোটাই তুলে দিলেন কোয়েবেলের হাতে। সে বছরের ২৫ আগস্ট কোয়েবেলের জাহাজ যাত্রা শুরু করলো সানফ্রান্সিসকো থেকে অস্ট্রেলিয়ার পানে। প্রায় একমাস পরে তিনি পৌঁছুলেন অ্যাডিলেডে। তিনি ছুটে গেলেন বাগানগুলোতে যেখানে সাইট্রাস জাতীয় গাছের চাষ হয়। খোঁজতে শুরু করলেন সেই কটনি কুশন স্কেল পোকা যার শত্রুর খোঁজে তিনি এসেছেন। কিন্তু আজব ব্যাপার হল পুরো বাগান ঘুরেও তিনি দুই একটা স্কেল পোকা খুঁজে পেলেও কোন শত্রু পোকা খোঁজে পাননি। সেখানকার কৃষকরা নাকি কটনি কুশন স্কেল চিনেনইনা আর সেটার শত্রু পোকা তো দূর অস্ত। সেইসময়ে তিনি আবারো চিঠি লিখেন ক্রফর্ডকে যিনি বস রিলেকে বলেছিলেন একটি প্যারাসিটয়েডের কথা। ক্রফর্ড জানালেন তারা কিছু স্কেল পোকা পেয়েছেন যেগুলো প্যারাসিটয়েড দ্বারা আক্রান্ত।

অক্টোবরের দিকে কোয়েবেলে স্কেল পোকার কিছু স্যাম্পল পাঠাবেন রিলের কাছে, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন একটি লেডি বার্ড বিটল বা Vedalia cardinalis একটি বড় সাইজের স্কেল পোকাকে খাচ্ছে।

ভেদালিয়া বিটল ভক্ষণ করছে স্কেল পোকাকে। ছবি: এনাটমি এন্ড নেমাটোলজি বিভাগ, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ ঘটনা দেখে তিনি চিঠি লিখলেন রিলের কাছে। অবশ্য রিলে বললেন ঐ প্যারাসিটয়েডকেই খুঁজতে। অগত্যা কোয়েবেলে আবার শুরু করলেন ঘুরাঘুরি। এবার তিনি গেলেন মুরে নদীর অববাহিকায় যেখানে প্রচুর কমলার চাষ হয়। এখানে তিনি লেডি বার্ড বিটল এবং সেই প্যারাসিটয়েড দুটিই পেলেন। এগুলো নিয়ে চলে আসলেন অ্যাডিলেডে। তারপর প্রায় ৬০০০ স্কেল পোকা সহ তিনি কিছু Cryptochaetum iceryae পাঠালেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। খুব সাবধানতার জন্য সেগুলো পাঠানো হয়েছিলো। ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বর এ তিনি সিডনি টাউন হল গার্ডেন থেকে প্রায় ২০০ বিটল এবং তার পরের বছর নিউজল্যান্ডের নেপিয়ার থেকে প্রায় ৬০০ বিটল সংগ্রহ করেন। এসবগুলোই তিনি পাঠিয়ে দেন লসএঞ্জেলসে থাকা তাঁর সহকর্মী কনকুইলেটের কাছে। কোয়েবেলে নিজের সাথে নিয়ে আসেন ১২০০০ ক্রিপ্টোচেটাম প্যারাসিটয়েড। ১৮৮৯ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই যতগুলো আক্রান্ত গাছে এই পোকাগুলো ছাড়া হয়েছিলো সবগুলো গাছের স্কেল পোকাই মারা পড়েছিলো। এর মধ্যেই চাষীরা নিজেদের মধ্যে এই বন্ধু পোকাগুলো ভাগাভাগি করা শুরু করলো। ১৮৮৯ সালের শেষের দিকে স্কেল পোকা আর তেমন কোন ক্ষতিকর পোকা হিসেবে গণ্য হল না। ১৮৯০ সালে পুরোপুরিভাবে স্কেলপোকা মুক্ত হল ক্যালিফোর্নিয়া। মাত্র ২০০০ ডলারের বিনিময়ে বাঁচলো লক্ষ লক্ষ ডলার। এদিকে এত কষ্ট করলেন কোয়েবেলে; তাকে কি একেবারে খালি হাতে ধন্যবাদ দেয়া যায়।

জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করলো ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসীরা। তাঁকে পরিয়ে দেয়া হল একটি স্বর্নের হাতঘড়ি আর তাঁর স্ত্রীকে উপহার দেয়া হল একজোড়া হীরার কানের দুল।

তথ্যসূত্র-

www.biologicalcontrol.info

https://en.wikipedia.org/wiki/Biological_pest_control

http://anbp.org/index.php/history-of-biocontrol