আসাম যে কারণে অারাকান হবে না

আসাম যে কারণে অারাকান হবে না

পহেলা মে, ২০১৪। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত পরিবারের কয়েকজন বাড়ির উঠোনে বিশ্রাম নিচ্ছে। মুখ-ঢাকা চারজন মোটরসাইকেল আরোহী বাড়িতে হঠাত ঢুকে পড়ে। ঢুকেই এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করে চারিদিকে। ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যায়। আহত হয় দুই শিশু। যাদের মধ্যে তিন বছরের শিশুটির হাতের করতল ভেদ করে গুলি বের হয়ে যায়! ঘটনাটি এতো দ্রুত ঘটে যে, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই তারা পালিয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হামলাকারীরা বোড়ো উপজাতিদের সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য। হিমালয়ের পাড় ঘেঁষা আসামে এসব নিত্ত-নৈমিত্তিক ঘটনা। আসামের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে সেখানকার উপজাতিদের মধ্যে জনসংখ্যায়-সর্ববহুল বোড়ো জনগোষ্ঠীর এই রক্তের খেলা আজ অব্দি চলছে। যেন সবকিছু একরকম দুধভাতে পরিণত হয়েছে।

এই সংকট-ঘনীভূত হয় মূলত ১৯৮০ সাল থেকে। যখন বোড়ো উপজাতিরা যাদের আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-ধর্মাবলম্বী; তারা নিজেদের জন্য আলাদা বাসভূমি “বোড়োল্যান্ড”এর দাবি তোলে। এবং আসামের মুসলিমদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেয়। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় আসামের নেলি শহরে বোড়ো আর মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় দুহাজার নারী-পুরুষ নিহত হয়। এর মাঝে আরো কয়েকবার একই ঘটনা ঘটে। দেখা গেল, ২০১২ সালের জুলাই মাসে কোকড়াঝাড় এবং চিরং জেলায় এরকম হামলায় প্রায় একশ মুসলিম নিহত হয়েছে। ঘরহারা হয় প্রায় সাড়ে তিনলাখ। সে বছরের মে মাসে ঘটে তার চেয়েও ভয়াবহ হামলা। মাসের প্রথম দুদিনে অতর্কিত হামলায় প্রাণ হারায় প্রায় পঞ্চাশ জন। হামলার কারণ হিসাবে ধারণা করা হয়, কোকড়াঝাড় লোকসভা নির্বাচনে বোড়ো আদিবাসীদের প্রার্থীর বিপরীতে আসামের মুসলিমসহ বাকিদের সমর্থনে উলফার প্রার্থী প্রদান। উক্ত জেলায় মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৫ শতাংশ বোড়ো উপজাতি, স্বভাবতই সে নির্বাচনে তাদের জিতে যাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর।

ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এই ঘটনাটির প্রভাব ব্যাপক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ২০১৪ সালের নির্বাচনী বক্তৃতায় জিতলে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাক্স-পেটরাসহ’ বিদায় করবেন বলে আওয়াজ তোলেন। যার জের ধরে গত বছরের(২০১৭) ডিসেম্বরের শেষদিন সরকার কতৃক আসামে যারা নাগরিকত্ব পাবে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়। বিবিসির বরাতে জানা যায়, তিন কোটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক কোটি প্রাথমিকভাবে নাগরিকত্ব পাবে বলে জোর আলাপ আছে। এ বিষয়ে সরকারি ভাষ্য হিসাবে জানা যায়, যারা একাত্তরের আগে আসামে বসবাস করছেন মর্মে প্রমাণাদি পাওয়া যাবে তাদেরই নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। আর বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে ধারণা করা যাচ্ছে, নাগরিকত্ব-প্রাপ্তিতে ব্যর্থদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই বিষয়ে পরিস্কার বক্তব্য পাওয়া যায় রয়টার্সের বরাতে দেওয়া আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য।

তিনি বলেছেন, এই তালিকা তৈরির উদ্দেশ্য ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ চিহ্ণিত করা। এবং শর্মা এই তালিকা তৈরির দায়িত্বে আছেন বলে জানা যায়। তিনি আরো বলেন, ‘যাদের নাম এই তালিকায় থাকবে না, তাদের বহিস্কার করা হবে। আমরা এক্ষেত্রে কোন ফাঁক রাখতে চাই না। এজন্যে সব ধরণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে’। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হিন্দুরা বাংলাদেশে নির্যাতনের স্বীকার হয়, তাই সেক্ষেত্রে হিন্দুদের আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিব।’

অথচ আসামের মুসলিমরা বলছেন, তারা আসলে ব্রিটিশ সরকারের সময় আসামের চরাঞ্চলে চাষাবাদের কাজে এসেছিলেন। অনেকের দাদা-নানা পর্যন্ত এখানে বসবাস করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট প্রমাণাদি না থাকায় তারা আজ শঙ্কায় আছেন। উল্টো দিকে সরকার থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। মাদকসহ নানা অবৈধ জিনিস পাচারের মাধ্যমে তারা ঐ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এমনকি ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আসামের অস্থিতিশীলতা বিষয়ে দেওয়া এক রায়েও বিজেপির এই বক্তব্যকে প্রতিফলিত করেছে। তবে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কিছু জানে না বলে রয়টার্সকে জানান বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তবে আসামে ক্ষমতাশীল বিজেপিসহ কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভয়াবহ রূপ দিতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এই ধরণের নিপীড়নমূলক সরকারি সিদ্ধান্ত উগ্রবাদকে উসকে দিতে পারে। উলফা (১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা) এর মত সশস্ত্র সংগঠনগুলো আবার মাথাচাড়া দিতে পারে বহুজাতির দেশ ভারতে। উল্লেখ্য, এই ধরনের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ ভারতের সেভেন সিস্টার্সসহ অন্যান্য রাজ্যে নিভু নিভু করে জ্বললেও চলমান আন্দোলনকে নতুন মোড় দিতে পারে। উলফা এখন পর্যন্ত ভারতে নিষিদ্ধ সংগঠনের অন্যতম (১৯৯০ সাল) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।

 

আসাম কি তাহলে নতুন আরাকান?

আসামের আছে লড়াইয়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের বাঙালির মত তাদেরও আছে মায়ের ভাষার জন্যে জীবন আত্মদানের নজির। ১৯৬০ সালে যখন অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি। যেখানে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলা ভাষাভাষী প্রায় ৩০ শতাংশ। সে খবরে তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষা বরাক উপত্যকায় সত্যাগ্রহের ন্যায় তীব্র আন্দোলনের ডাক দেয় তারা। সেখান থেকে আন্দোলনের তিন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন এবং বিধুভূষণ চৌধুরী সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন। এতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্যাপক পুলিশী হামলায় আন্দোলনকারীদের নয় জন নিহত হয়। আহত হয় শতাধিক। এছাড়া উলফা বারবার স্বাধীন আসামের দাবি তুলে ভারত সরকারের সাথে দর কষাকষির অবস্থা বজায় রেখেছিল বেশ কয়েক বছর। তবে উলফার কার্যক্রম আজকাল অতটা দৃশ্যমান না থাকলেও চীনের সাথে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে সবসময়ে আমলে নিতে হবে।

বিবিসির প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, পরেশ বড়ুয়াসহ অনেক নেতা চীনের বর্ডারে আশ্রয় নিয়েছে নানা সময়। এছাড়া গতমাসে সেখানের একজন মুসলিম নেতা হুঁশিয়ারি দেন যে, ‘ধর্মের ভিত্তিতে যদি নাগরিকদের তালিকা করা হয়, সেটি ভারতের জন্য ‘ভয়ংকর’ হবে এবং অস্থিরতা তৈরি করবে।’ দু দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও আসামের বাঙালী মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তালিকা থেকে বাদ পড়াদের আসাম থেকে বের করার কোন চিন্তা করা হলে সেটা হবে আগুন নিয়ে খেলা।’ ফলে দেশের ভিতরে-বাইরে একধরনের সুষম যোগাযোগ তারা চাইলে করতে পারে। তাই রোহিঙ্গাদের মত তারা সে ধরণের পরিস্থিতিতে পড়বে না বলে ধারণা করা যায়।

তবে এখন পর্যন্ত আসামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় রাজ্যজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ‘স্ট্যান্ড-বাই’ রাখা হয়েছে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

উল্লেখ্য, এই নাগরিকত্ব প্রদানের তালিকার আগে ১৯৫১ সালে ভারতে একটি নাগরিক তালিকা তৈরি হয়েছিল। তারপর এমন অভিযান আর হয়নি। তাছাড়া আসামের নাগরিকত্ব প্রশ্নে আগামী এপ্রিলে উচ্চ আদালতে একটি শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।