১৮৩৮ সালে প্রথম দূতাবাস খোলার ঠিক ৭৯ বছর পর জেরুজালেম দখল করে নেয় ব্রিটেন। হাজার বছর পর মুসলমানদের হাতছাড়া হয় এ পবিত্র ভূমি। অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৬৯ বছর পর আবার আমেরিকা জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস খোলার ঘোষণা দিল। মুসলমানদের জেরুজালেমে হাতছাড়া হবার ঠিক ১০০ বছর পর।
হিজরি ৬৩৭ আল্লাহ্র রাসুল দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন ৫ বছর হল। উমার রা. মুসলিম দুনিয়ার সর্বাধিনায়ক। একে একে রোমানদের পরাজয় নিশ্চিত। মুসলমানরা জেরুজালেম অবধি পৌঁছে গেল। অবরুদ্ধ করল শহরবাসীদের। ৪০ হাজার জানবাজ সাহাবা চাইলেই কেবল তলোয়ারের আঘাতে জেরুজালেমের কতৃত্ব নিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা রক্তপাত এড়িয়ে গেলেন। খ্রিস্ট নেতাদের দাবির মুখে খোদ উমার রা. দীর্ঘ, ক্লান্তিকর মরুপথ পাড়ি দিয়ে আসলেন। পায়ে হেঁটে প্রবেশ করলেন শহরে। আসার পথে তাঁর সঙ্গে না ছিল নিরাপত্তা বহর, না ছিল প্রহরীর দল। তিনি সন্ধিপত্রে সাক্ষর করলেন। ঘোষণা দেওয়া হল-
১. সকল ধর্মের লোকদের ইসলামি শাসনের অধীন নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেওয়া হল। সকল ধর্মের লোকের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হল। ১৩৫ সালে জেরুজালেমে খ্রিস্টশক্তি হিসেবে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের বিজয়ের পর এই প্রথম শত শত বছর বাদে ইহুদিদের বসবাস ও ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেওয়া হল। শহরের বাইরে উদ্বাস্তু ৭০টি ইহুদি পরিবারকে তিনি নগরে আমন্ত্রণ জানান।
২. যে কেউ চাইলে নিজ সম্পদসহ, নিরাপদে প্রশ্নহীনভাবে শহর ত্যাগ করার স্বাধীনতা পেল।
৩. প্রত্যেকের ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তা দেওয়া হল। গীর্জাসমূহ, সিনাগগসহ।
৪. যে সমস্ত অমুসলিম নাগরিক নিজের যাবতীয় খরচাদি সম্পন্ন করার পর স্বচ্ছন্দে করের অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন তাদের উপর সহনীয় পর্যায়ে ট্যাক্স আরোপ করা হল। বাকী সবাইকে কর মওকুফ করে দেওয়া হল।
৫. সকলের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হল।
জেরুজালেম মুসলিম ফিলিস্তিনের অংশ হয়ে উঠল। খলিফা নগর পরিদর্শনে বেড়িয়ে যাজকদের অনুরোধে চার্চ পরিদর্শন করলেন। আসরের নামাজের সময় হলে, প্রধান যাজক সেফার্নিয়ার অনুরোধ করলেন যেন তিনি গীর্জাতেই নামাজ আদায় করেন। উমার রা. তা করলেন না- তিনি শঙ্কা করে বললেন, তিনি নামাজ আদায় করলে, মুসলমানরা এটাকে দলিল মেনে মসজিদে রূপান্তর করতে পারে। ইহুদিদের বহিষ্কারের পর থেকে খ্রিস্টানরা মসজিদ আল আক্বসার স্থানকে ময়লা ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করত। উমার রা. নিজ হাতে হারাম শরীফের উপর আবর্জনা পরিষ্কার করে তাতে মসজিদ নির্মাণ করেন। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালেক এর উন্নয়ন করেন।
১০৯৫ সাল, রোমান সম্রাট এলেক্সিওস পোপ আরবান সেকেন্ডের কাছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহায্য চান। পোপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুশেড ঘোষণা করেন। মুসলমানরা সেসময় বর্তমানের মতই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। সেই সুযোগে খ্রিস্ট শক্তি অনেক প্রদেশ বিনাযুদ্ধেই অতিক্রম করে জেরুজালেম অবধি পৌঁছে যায়। অপরদিকে সেলজুক আর ফাতেমিদের মধ্যে জেরুজালেম নিয়ে কিছুকাল পূর্বেই যুদ্ধ হয় এবং লড়াই চলমান ছিল। সে অবস্থায় ফাতেমিরা পুনরায় জেরুজালেমের দখল নিলেও এত স্বল্প সময়ে নগরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করে উঠতে পারে নি, সেলজুকরাও নগরের নিরাপত্তা দিতে তখন ব্যর্থ ছিল। ১০৯৯ ক্রুশেড বাহিনী জেরুজালের পবিত্রভূমিতে পৌঁছে যায়। ১৫ জুলাই মুসলমানদের পতন হয়। তবে আত্মসমর্পণ পত্রে শর্ত ছিলঃ
১. শহর থেকে কাউকে বন্দী করা হবে না।
২. প্রত্যেকেই নিরাপদে নগর ত্যাগ করতে পারবে। কিন্তু নগরে প্রবেশ করেই ক্রুশেড নেতা গডফ্রে, নির্দেশ দিলেন সকল মুসলিম ও ইহুদিদের হত্যা করতে। কেবল মসজিদুল আকসায় এই পরিমাণ মুসলমানকে হত্যা করা হয় যে রক্ত হাঁটু অবধি পৌঁছে গিয়েছিল বলে উপস্থিত ক্রুশেডারদের কেউ কেউ উল্লেখ করে গেছেন।
মুসলমানদের নগরে নিষিদ্ধ করা হয়। তিন দিনব্যাপি গণহত্যা চালিয়ে নারী-শিশুসহ ৭০ হাজার নিরীহ মুসলমান এবং ইহুদিদের হত্যা করা যায়। চুক্তির যাবতীয় শর্ত ভঙ্গ করা হয়। বায়তুল আকসার সমস্ত ইসলামি নিদর্শন মুছে দেওয়া হয়। গডফ্রে এটাকে নিজের প্রাসাদ হিসেবে গ্রহণ করে। পরে এই পবিত্র মসজিদকে গীর্জায় বদলে দেওয়া হয়। ৪৬২ বছরের ইসলামি শাসনের পতন ঘটে। পোপ এই সমস্ত হত্যা পাপ নয় বলে খ্রিস্ট জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন।
এর ঠিক ৮৮ বছর পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ: ১১৮৭ সালে জেরুজালেম পুনরায় বিজয় করে নেন। তিনি কি করেছিলেন,
১. নগরের সকল যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেন, কোনও গণহত্যা সেদিন হয় নি।
২. যারা মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ ছিল নিজ অর্থে সুলতান তাদের মুক্তিপণ আদায় করে নেন।
৩. কেবল ভয়াবহ যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযোগ প্রমাণিতদের তিনি দণ্ডবিধান করেন।
তিনি শীঘ্র পবিত্র হারাম শরীফের দখল নেন। নিজ হাতে সংস্কার করে। খ্রিস্টানদের মসজিদের ভিতর হারামের অংশে করে রাখা টয়লেট তিনি নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। নিজ হাতে গোলাপজলে মসজিদ ধৌত করেন। এর ৭৩০ বছর পর ব্রিটেন ১৯১৭ সালে জেরুজালেম দখল করে নেয়।ব্রিটিশ জেনারেল এলেনবি ঠিক উমার রা. এর মত শহরে হেঁটে প্রবেশ করে। শ্রুত আছে তিনি নগরের মাটিতে চুমু খেয়ে এ কথাও ঘোষণা করেছিলেন, আজ ক্রুসেডের সমাপ্তি হল। সেখানে মুসলিম যুবকদের গ্রেপ্তার করে বন্দীশিবিরে পাঠানো হয়, বহু আলেম হত্যার শিকার হন, সম্পদশালী মুসলমাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হয়। তারপর ইসরায়েল রাষ্ট্র কায়েম। হাজার হাজার বছরের ফিলিস্তিনি এই পবিত্র ভূমিকে ইসরায়েল নিজের দখলে রাখলেও এর কোনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল না। যেখানে ফিলিস্তিন জেরুজালেমকে তার নিজের রাজধানী হিসেবে স্বপ্ন দেখে, সেখানে অকৃতজ্ঞ ইহুদিদের রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতির অংশ হিসেবে সেখানে আমেরিকা নিজেদের দূতাবাস সরানোর ঘোষণা দিয়েছে।
আজ ১০০ বছর হল আল-কুদুসের পবিত্র ভূমি মুসলমানদের হাতছাড়া হয়েছে। এত দীর্ঘ সময় আর কখনো এ পবিত্র নগরের সেবা থেকে বঞ্চিত হয় নি। সেবার যখন মুসলমানের পতন হয়। সে খবরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভের সঞ্চার হতে শুরু করে। সেকালে উম্মাহর এমন যুবক জন্ম নেয় নি যে, সে তাঁর যৌবন ঐ পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার স্বপ্ন সে দেখে নি। বহু স্বপ্ন, পরিকল্পনা, বিভেদের রেখা মুছে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবির হাত ধরে তা ডানা মেলেছিল জেরুজালের উপর। দুশমনদের হাত থেকে তারা সেই পবিত্র ভূমি মুক্ত করেছিল। আর মুসলমানদের অবস্থা তো এমন, নিজেদের পবিত্র ভূমি উদ্ধার দূরে থাক- ছুটে যায় দুশমনের ভূমির উদ্দেশ্যে। ইউরোপে-আমেরিকায়, দুশমনের অনুগত নাগরিক হয়ে থাকতে। কিংবা নিজেদের ভূমিতে থেকেও তাদের গোলামিতে মত্ত থাকি।