মাশরাফির টি-টুয়েন্টি অবসর; প্রশ্ন থেকেই যায়

মাশরাফির টি-টুয়েন্টি অবসর; প্রশ্ন থেকেই যায়

আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি থেকে কি তবে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই অবসরে চলে গেলেন মাশরাফি? এ প্রশ্নটি অবধারিতভাবে উঠে আসছে বিপিএল এর পাঁচ আসরের চারটিতেই শিরোপা জিতে নেওয়ার কারণেই না বরং এবারের আসরে যেমন করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রুপ পর্বে অনেকটাই হিসাবের বাইরে থাকা রংপুরকে বিজয় এনে দিলেন সে কারণেও।

শ্রীলংকা সফরের শেষ টি টোয়েন্টির আগে আচমকা অবসরের ঘোষণা মাশরাফি ভক্তদের কাছে ছিল আকস্মিক এক আঘাত। ফেসবুকে ও সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি যা বলেছিলেন তা যে মন থেকে না বরং বাধ্য হয়ে বলেছেন সেটি স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল ম্যাচ শেষে তার হতবিহ্বল চেহারা দেখে। বার দুয়েক নাম ঘোষণার পরেও যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না ঘোষকের কথাগুলো। হয়তো মনের ভেতরে ঝড় চলছিল। দল দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবার সময় সবশেষ পরিহাসের জন্ম দেন বোর্ড প্রধান। তিনি যখন বলেন যে, মাশরাফি অধিনায়কত্বই ছেড়েছেন শুধু, টি টোয়েন্টি না; পাশেই বসা মাশরাফির হাসিই বলে দিচ্ছিল কোন প্রহসনের শিকার তিনি। আর, তখনই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় যায় যে, স্বেচ্ছায় নয় বরং স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে নিজের সম্মান বাচাতেই এ অকাল অবসর। আমরা ঠিক নিশ্চিত নই, কার অধীনে মাশরাফিকে খেলানোর স্বপ্ন দেখছিলেন বোর্ড প্রধান।

কথিত আছে যে, হাথুরুসিংহ নাকি মাশরাফির গতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার বদলে গতি সম্পন্ন কোন বোলারকে খেলানোর গোপন মনোবাসনা প্রকাশ পায় মাশরাফির অবসরে। সঠিক লাইন লেংন্থ বজায় রেখে ব্যাটসম্যানকে চাপে রাখার বদলে শুধুই গতির ঝড় তুলতে সক্ষম এমন বোলারের হালত কি হতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে চলতি বিপিএলেই। আসরের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার ছিলেন খুলনার ক্যারাবিয়ান বোলার জোফরা আর্চার। তার ধনুক থেকে বিদ্যুত গতির তীর বের হলেও নিশানা ছিল এলোমেলো। অপর দিকে ‘স্লথ গতি’র মাশরাফি বেশ কবারই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়া স্পেল উপহার দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে বাংলাদেশের অন্যতম দ্রুতগতির বোলার তাসকিনের নামও। আর্চারের দল তো তাও প্রথম চারে থেকে দাপটের সাথেই গ্রপ পর্ব শেষ করেছিল। সেখানে তাসকিনের চট্টগ্রাম ছিল শেষের দিক থেকে প্রথম স্থানে! মাশরাফির ওভার গুলোতে যেমন লাগাম ছুটে যায় যায় অবস্থা থেকে খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রংপুর সেখানে তাসকিনের গতির তান্ডবে চট্টগ্রাম দলপতি লুক রনকিকে বেশ কবারই অসহায় দেখা যায়। চেয়ে চেয়ে দেখেছেন হাতে থাকা ম্যাচের লাগাম হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখতে। শুধুই গতি যদি সব হত তাহলে ম্যাকগ্রা, পোলক বা ভাসদের নামও বোধ করি কেউ জানত না।

হাথুরু অবাধ ক্ষমতা চাইতেই পারেন, কিন্তু বোর্ড সেটি মানবে কেন? কেনই বা তার সে ইচ্ছা পূরণের খেসারত দিয়ে সরে দাড়াতে হবে মাশরাফিকে?

 

এ তো গেল বোলার মাশরাফির কথা। ব্যাটহাতে এবার নিজেকে আবারও চিনিয়েছেন নতুন করে। ‘নতুন করে’ বলছি কারণ, বোর্ড কর্তাদের হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল না যে, তারা মাশরাফির এই যোগ্যতা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞাত। কখনও তিনে উঠে এসে কখনও বা নীচে থেকে বিরদর্পে ম্যাচ জিতিয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। যে দলে গেইল, ম্যাককালামদের মতো টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট রয়েছেন তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিখাদ ব্যাটসম্যান না হয়েও ব্যাটিং ক্ষমতার প্রদর্শন শুধু মাশরাফির পক্ষেই সম্ভব।

এবার আসি অধিনায়ক মাশরাফির কথায়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া রবি বোপারা অধিনায়ক মাশরাফির প্রশংসা করেছেন প্রকাশ্যেই। মুগ্ধতা ঝরেছে ম্যাককালাম গেইলদের কন্ঠেও। যার অধিনায়কত্ব নিয়ে বিশ্ব তারকারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি আসর শেষে ফাস করেছেন সাফল্যের গোমর। অস্ট্রেলিয়ান কোচ টম মুডির পুরো আস্থা ছিল বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কের ওপর। বেশ কিছু ফাটকা খেলেছেন মাশরাফি, কখনও ফল হয়তো পক্ষে গিয়েছে কখনও বিপক্ষে কিন্তু, এই অজি কোচের আস্থায় সামান্যতম চিড় ধরেনি। অবাধে খেলতে পারার স্বাধীনতা পেলে মাশরাফি যে সাদামাটা মনে হওয়া একটি দলকেও কল্পনাতীত সাফল্য এনে দিতে পারেন তার আরো একটি অনুপম প্রদর্শনি ছিল এই বিপিএল।

পরিহাসের বিষয়, সামান্য কদিনের পরিচয়ে যেখানে টম মুডি মাশরাফিকে দিয়েছেন নিজের মত করে দল সাজাবার, সিদ্ধান্ত নেবার অগাধ ক্ষমতা; সেখানে, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে সর্বোচ্চ সাফল্য এনে দেয়া মাশরাফিতেই আস্থা রাখতে অনীহা ছিল হাথুরুর। নিজের জায়গা থেকে হাথুরু হয়ত দলের লাগাম নিজের হাতেই রাখতে চেয়েছিলেন, সেটি করতে গিয়ে যে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে তার সম্পর্ক তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল তার নমুনা দেখা গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকের মন্তব্যগুলোতেই। হাথুরু অবাধ ক্ষমতা চাইতেই পারেন, কিন্তু বোর্ড সেটি মানবে কেন? কেনই বা তার সে ইচ্ছা পূরণের খেসারত দিয়ে সরে দাড়াতে হবে মাশরাফিকে?

ছবিটি মাশরাফি বিন মর্তুজার ফেসবুক থেকে নেওয়া

এ প্রশ্নটিকে আরও জোরালো করে তুলছে জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েব সাইট ক্রিকইনফোর বিপিএল সেরা একাদশটি। যে দলে টি টোয়েন্টির ব্র্যাডম্যান ক্রিস গেইল এবং বর্তমান বাংলাদেশ দলপতি সাকিব আল হাসান থাকা সত্ত্বেও বিশ্লেষকরা মাশরাফিকেই বেছে নিয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে। শুধু নেতৃত্বগুণই নয়, বরং ব্যাট বল হাতে যেভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাতেই স্পষ্ট মাশরাফি নামক গোলা এখনো সমান কার্যকর। এর সাথে যোগ করি স্থানীয় ক্রিকেটারদের সাথে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় নামগুলোকে এক সুতোয় গাথতে পারার সহজাত ক্ষমতা। অনেক আনকোরা স্থানীয় ক্রিকেটারের কাছ থেকে কল্পনাতীত সাফল্য বের করে এনে সচল রাখছেন জাতীয় দলের মূল একাদশের বিকল্প খেলোয়াড়দের পাইপ লাইন। এর আগে কুমিল্লায় তার নেতৃত্বে আলো ছড়িয়েছিলেন আবু হায়দার রনি। এবার, ঝলক দেখিয়েছেন মিঠুন চৌধুরী, নাজমুল হাসান অপুরা। মিঠুন তো জায়গা পেয়েছেন বিপিএল এর সেরা একাদশেই, অপুও ডাক পেয়েছেন আসন্য ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রাথমিক দলে।

সামান্য কয়দিনের পরিচয়েই যেখানে মুডি পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিলেন মাশরাফিতে, সেখানে স্বদেশের বোর্ডই মাশরাফিকে বাধ্য করেছেন সরে দাঁড়াতে! অবশ্য এমন নজির তো প্রথম না। এর আগেও দেখা গিয়েছে, নিজের মান বাঁচাতে সামর্থ্য থাকার পড়েও সরে গিয়েছিলেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে এক শ উইকেটের মাইলফলক ছোয়া মোহাম্মদ রফিকও।

মাশরাফি ফিরে আসুক, এমন কোন চাওয়া নেই আমাদের। বরং, বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই বঙ্গ সন্তান স্বসম্মানেই থাকুন, এটাই চাওয়া। তাঁর অবসরে মাশরাফি নিজে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন জানি না, কিন্তু তাঁর বিকল্প পেতে বাংলাদেশকে যে বহু বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে তা চোখ বুজেই বলে দেয়া যায়। দু হাটুতে সাতটি অস্ত্রপোচার নিয়েও খেলে যাবার মত সাহস পৃথিবীর বুকে শুধু এই একজনেরই আছে। আফসোস একটাই, ভিনদেশিরা যেখানে এই রত্নের সংস্পর্শে এসে নিজেকে ধণ্য ভাবে সেখানে আমরা বাধ্য করি তাকে অবসর নিতে !!!