গত ২৮শে ডিসেম্বর থেকে ইরানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত শহর মাশহাদ, ইজেহ, কোমসহ কিছু এলাকায় ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির’ প্রতিবাদসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভের শুরুটা সাধারণ একটা র্যালি দিয়ে হলেও ৩০শে ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়িতে আগুন দিলে পরিস্থিতি চরমে চলে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় ১২ জন নিহত এবং চারশ’র বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। সমগ্র দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যোগাযোগের নানা সামাজিক সাইটগুলো।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন, ইরানের বর্তমান সরকারকে বলেছেন সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী। ইরানের সরকারকে তিরস্কার করে ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রীও বিবৃতি দিয়েছেন। এসবের জবাবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, তার উচিত অন্য দেশের বিষয়ে এভাবে টুইট না করে নিজেদের কাজে মন দেওয়া। তবে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে এবং প্রতিবাদের অধিকার মেনে নিলেও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই বিক্ষোভকে ইরানের শত্রুগোষ্ঠী দ্বারা ‘প্ররোচিত’ হয়ে গুটিকয়েক লোকের ‘বিশৃংখলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এ বিষয়ে শত্রুদের নাক গলাতে বিরত থাকতে আহবান জানান।
এর আগে ২০০৯ সালে ড. হাসান রুহানির পুর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মেয়াদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছিল। মূলত সে নির্বাচনে আহমেদিনেজাদের অবৈধ প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মীর হোসাইন মুসাভির সমর্থকরা সেই বিক্ষোভের ডাক দিলে বেশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরে সে বিক্ষোভ নানা কারণে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এবারের বিক্ষোভেরও একই পরিণতি হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। এই আশংকার কারণগুলোর মধ্যে আছে; যোগ্য নেতৃত্বের সংকট, সংখ্যাগুরু শহুরে মধ্যবিত্ত ইরানীদের অনাগ্রহতা, বিক্ষোভের ইস্যুর অস্পষ্টতা।
বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের ইতিহাসে ২০০৯ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত বিক্ষোভ। তবে সেটি ব্যর্থ হওয়ার পিছনে অনেকেই দেশে বা দেশের বাইরের কোন যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না উঠার কারণকে দুষেছেন। এবারের চলমান বিক্ষোভটিও এখন পর্যন্ত কোন নেতৃত্বের অধীনে আসতে পারেনি। যদিও রুহানীর সাবেক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী এব্রাহিম রাইসির জন্মস্থান বলে পরিচিত ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদ থেকে বিক্ষোভের সুত্রপাত হয়েছে। ফলে অনেকে এ বিক্ষোভের পেছনের ক্রীড়নক হিসাবে রাইসির দিকে অঙ্গুলি তুলছেন। তবে এখন পর্যন্ত ঘোষিত কোন নেতৃত্বের অধীনে বিক্ষোভকারীরা নেই।
দ্বিতীয়ত, ২০০৯ সালের আহমেদিনেজাদ-বিরোধী বিক্ষোভে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের বেশিরভাগ শহুরে মধ্যবিত্ত। তবে পরবর্তী নির্বাচনে সেই মধ্যবিত্তরাই রুহানীকে জিতে আসার পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। ফলে তারাই আবার রুহানী-বিরোধী বিক্ষোভে যুক্ত হবেন কিনা সেই বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়। তার ওপর আছে সরকারের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা।
তৃতীয়ত, সপ্তাহব্যাপী চলমান এই বিক্ষোভের গতি-প্রকৃতি এবং তার উদ্দেশ্য নিয়ে রয়ে গেছে ঘোর অস্পষ্টতা। শুরুটা নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হলেও পরে সেটি ব্যানারে-শ্লোগানে সরকার-বিরোধী, বিপ্লব-বিরোধী বিক্ষোভে পরিণত হয়। শ্লোগান ওঠে, “এ বিপ্লব আমরা চাইনি”, “রুহানির মরণ হোক”, “ক্ষুধার্তের আরতি শোনো” ইত্যাদি। বিক্ষোভ থেকে রুহানির ছবিও পোড়ানো হয়।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এক অফিশিয়াল বার্তায় এই বিক্ষোভকে “শত্রুদের” সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, “শত্রুরা কিছুদিন ধরে অর্থ, রাজনীতি, গোয়েন্দাবৃত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের পবিত্র ইসলামী শাসনের দেশকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে”। এদিকে রাশিয়াও রুহানি সরকারের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। মস্কোর পররাষ্ট্র বিভাগ “ইরানকে বাইরের শক্তি অস্থির করার চেষ্টা করছে” মর্মে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে। এর ফলে এই বিক্ষোভকে ঘিরে একধরনের আন্তর্জাতিক মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাড়িয়েছে। বিদেশি শত্রুদের ইন্ধনে বিক্ষোভ পরিচালিত হচ্ছে, ইরানি নেতাদের করা এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিক্কি হ্যালি বলেছেন, “এটা পুরোপুরি স্বতঃস্ফুর্ত একটা বিক্ষোভ, ইরানের সব শহরেই বিক্ষোভকারীরা ভার্চুয়ালী সক্রিয় রয়েছেন।”
ইরানের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ মতে, ‘যেকোন ইস্যুতে প্রকাশ্য প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে, তবে সেটি কোন ধরনের সশস্ত্র বা ইসলামের মৌলিক নীতি-বিরুদ্ধ হতে পারবে না’। সুতরাং এই বিক্ষোভকে সংবিধান-বিরোধীতার অভিযোগে তুলে এর বিরুদ্ধে সরকারের রেভ্যলুশোনারি গার্ডকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।