ক্রিকেটের এক নেপথ্যচারীর কথা

ক্রিকেটের এক নেপথ্যচারীর কথা

আশির দশকের ঢাকা। তখনও নবাবী আমলের নিদর্শনগুলো কালের অতল গহব্বরে তলিয়ে যায়নি। বর্তমানের মত দম বন্ধকর পরিবেশও ছিল না। গণী মিয়ার ঘোড়া দৌড়ের স্মৃতি বহু আগেই বিস্মৃতির অতলে ঠাঁই করে নিয়েছে। ক্রীড়া জগতের অধিকর্তা রুপে ততদিনে জায়গা করে নিয়েছে ফুটবল। ষাট-সত্তর দশকের চারা গাছটি ততদিনে বিশাল বটবৃক্ষে রুপ নিয়েছে। ক্রীড়ার সে বাগানে ফুটবল যখন সৌরভ ছড়াচ্ছে তখন এক কোণে অবহেলায় পড়েছিল ক্রিকেট। পরিচিতি বা জনপ্রিয়তায় ফুটবলের ধারেকাছেও নেই সেটি। আজকের এই অবস্থান তো দূর কি বাত ক্রিকেটের ছায়ায় যে ফুটবল ঢাকা পড়ে যাবে এমনটি সাধারণ মানুষের ভাবনায়ও ছিল না। তবে, যুগে যুগে কিছু স্বপ্নস্রষ্টা জন্ম নেন। যারা বদলে দেন চেনা দৃশ্য, ইতিহাসবিদদের বাধ্য করেন নতুন পাতা সংযোজন করতে। তেমনি একজনের গল্প শোনাব আজ। যিনি নিজেকে কোচ না বরং ক্রিকেটের রাখাল বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। এই নিবেদিত প্রাণ রাখালের হাত ধরে জন্মেছে এমন সব গাছ যাদের নাম কেউ মুছে দিতে পারবে না বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস থেকে।

মোহাম্মদ জলিসুর রহিম। নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেট মাঠে পা দিয়েছেন অথচ এই নামটি শোনেননি এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না। মৌসুমী খেলা ক্রিকেটকে শুধুমাত্র মৌসুমীতে না রেখে পুরো বছরব্যাপী অনুশীলনের মধ্যে রেখে পেশাদার কাঠামোতে নিয়ে আসার পেছনে স্যারের অবদান অসামান্য। ছয় বছর আগে শেষ যেবার দেখেছিলাম তখনও মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন সদর্পে। ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসের ডগার সাথে যার সম্পর্ক তার অনুপস্থিতিতে মাঠটা কেমন যেন ম্রিয়মাণ ঠেকত। এতদিন পর যখন স্যারের মুখোমুখি হলাম, বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। অসুখ বাসা বেধেছে শরীরে। কাশির দম আটকে কথা প্রায় আটকে যাচ্ছিল। শান্ত, সৌম্য অপূর্ব মুখশ্রীটার শ্রী বৃদ্ধি করেছে বুক সমান নেমে আসা সফেদ দাড়ি।

আজ থেকে আটান্ন বছর আগে সিলেটের মাধেশ্বরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম জলিসুর রহিমের। ক্রিকেট নামক ঝিঁঝি পোকাটা মাথায় নিয়েই জন্মেছিলেন। বংশে শিক্ষা দীক্ষার ধারাও বেশ পুরনো, স্যারের দাদা সেসময় বিখ্যাত আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান, শখের বশে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে। শখের ক্রিকেটের শাখায় বিচরণ ছিল স্যারের বাবা এবং বড়ভাইদেরও। বাবার কর্মসূত্রে ছোট বেলাতেই অলি-আওলিয়াদের মাজারের শহর সিলেট ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন নৌ বন্দর হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া নারায়ণগঞ্জে। সেই যে আসা হল, ফেরা আর হয়নি। বরং, এই বন্দর শহরকেই আপন করে নিয়েছেন নিজস্ব কায়দায়। বাবার হয়তো ইচ্ছে ছিলো পূর্বসুরীদের পথ ধরে জলিস স্যারও সুবিন্যস্ত কেশকে বশে এনে সরকারি কেউকেটা হয়ে ধরে রাখবেন পারিবারিক ঐতিহ্য। কিন্তু, ইতিহাস লিখবার জন্য যার জন্ম চার দেয়ালের আবদ্ধ কুঠুরিতে তার মন ভরে? এই ইতিহাস লিখতে গিয়েই ঘর ছেড়েছেন, ক্রিকেটের মায়ায় দিন রাত কাটিয়েছেন খেয়ে না খেয়ে।

একে একে জলিসুর রহিমের হাত ধরে উঠে আসতে থাকেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, জুয়েল হোসেন মনা, তানভীর আহমেদ টিটুরা। তখন, বয়সভিত্তিক বলুন জাতীয় পর্যায় বলুন বা জাতীয় দল; সব খানেই দাপটের সাথে মাঠ মাতাচ্ছিলেন জলিসুর রহিমের রত্নরা

শুরুটা ছিল বেশ কঠিন। আজকের দিনে যা কল্পনা করাও কষ্টসাধ্য। তখন নারায়ণগঞ্জে ক্রিকেট ছিল মৌসুমি খেলা। আর তাতে যে দলগুলো অংশ নিত তাদের বেশিরভাগই বাইরে থেকে কিছু খেলোয়াড় এনে লিগ খেলতো, শুধু জেতার আশায়। বড় কোন প্রত্যাশা বা কিছু করার পরিকল্পনা কখনো কাগজের পাতাতেও ঠায় পায়নি তখন। তাতে কি জলিস স্যারের মন ভরে? ভাবলেন স্থানীয়দের নিয়েই যদি একটা দল গড়ে বছরব্যাপী অনুশীলনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে একটা কাঠামো দাড়াবে। সেটাকে ঠিকঠাক মতো কাজে লাগাতে পারলে এই জমিতে শুধু ফসলই ফলবে না, সে ফসলের ফায়দা পাবে পুরো দেশ। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিন্তু, বলা যত সহজ কাজটা করে দেখানো ততটাই কঠিন। স্বপ্ন যার আকাশ ছোবার তাকে থামায় সাধ্য কার! কথিত অসাধ্যকে একনিষ্ঠ সাধনায় সম্ভব করতে পারেন বলেই তো তারা স্বপ্নস্রষ্টা। আর তাই, রাখাল জলিসুর রহিমের হাত ধরে ফলতে থাকে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, জাহাঙ্গীর আলম, জাকারিয়া ইমতিয়াজ, জুয়েল হোসেন মনা, তানভীর আহমেদ টিটুদের মত ফসল। যারা শুধু স্থানীয় পর্যায়েই না; মাঠ মাতিয়েছেন বয়স ভিত্তিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও।

“এখন তো কত সহজ সব কিছু। তখন তো এমন ছিল না। আমি খালি হাতে আমার ছেলেদের প্র্যাক্টিস করাইছি। গ্লাভস কিনার টাকা নাই”

আপন ঘরে অতিথি হয়ে উদরের জ্বালা মেটাবার জন্য বেছে নিলেন টিউশনির পথ। কিন্তু ফসল ফলাবার নেশায় মত্ত যে রাখাল; মাইনের টাকার পুরোটা দিয়ে তিনি নিজেই চলবেন? তাই কি হয়? সামান্য সে টাকা যতটা না ব্যয় হতো উদর শান্ত করতে তার চেয়ে বেশি ক্রিকেটের পেছনে। কেউ হয়তো ট্রাউজারের অভাবে মাঠে আসতে পারছেন না, কেউ বা এক জোড়া জুতার অভাবে। ভাবনা কি? জলিস স্যার আছেন না? যার মাঝেই সম্ভাবনার সামান্যতম সম্ভাবনা দেখেছেন তাকে মাঠে আনার জন্য যত প্রকার যুদ্ধাস্ত্র দরকার তার বন্দোবস্ত করেছেন সে সামান্য মাইনের টাকার সাথে ধার দেনা করে। এ করতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন স্থানীয় পঞ্চায়েতের, শুনেছেন অজস্র কটুবাক্য।

তখন, ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের আশেপাশে কোন খাবার দোকান ছিল না। খাবার জন্য যেতে হত দূরের এক হোটেলে। কখনো গিয়ে হয়তো কিছু আলুপুরি মিলেছে, কখনো বা গিয়ে দেখেছেন শূণ্য সবই। তখন মুড়ি মুখে গুজেই নেমে পড়েছেন মাঠ পরিচর্যার কাজে। এখনকার ওসমানী স্টেডিয়ামের রুপ লাবণ্যের কিছুই ছিল না তখন। বরং যে জায়গাটায় বসে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম সেই জায়গাটা দেখিয়ে বলেন আগে এই দিকটায় ছিলো বালু, মাঠের এক কোনে চাপকল। প্রথমে এসে চাপকল থেকে পানি এনে বালু ভিজিয়ে মাঠ প্রস্তুত করতেন প্র্যাক্টিসের জন্য। তাও এতো সহজ ছিল না। ফুটবলের ভরা জোয়ারে ক্রিকেটের প্রবেশের এই প্রচেষ্টা গণ্য হত অবৈধ অনুপ্রবেশ হিসেবে। তাই, দেখা যেত যে জায়গাটা কেবলই বশে এনেছেন সেখানে দস্যু রুপে হাজির হয়ে ফুটবলাররা দখল করে নিয়েছেন। বাকযুদ্ধে না জড়িয়ে বরং মাঠের আরেক কোন খুঁজে বের করে তাতে চালিয়েছেন অনুশীলন। বসবাসের জায়গা নিয়েও ভাবতেন না ওরকম। দিনের শেষে ফিরবেন কোথায়? কখনও দারোয়ানের সাথে কখনও বা রাইফেলস ক্লাবের সোফাকেই শয়নের স্থান বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন।

বহু কষ্টে বোনা বীজ থেকে প্রথম ফসল আসা শুরু করে আশি সালের দিকে। স্থানীয়দের নিয়ে গড়া সে দলে ছিলো জাহাঙ্গীর আলম, জাকারিয়া ইমতিয়াজদের মতো ক্রিকেটাররা। তারপর শুধুই এগিয়ে চলা। একে একে জলিসুর রহিমের হাত ধরে উঠে আসতে থাকেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, জুয়েল হোসেন মনা, তানভীর আহমেদ টিটুরা। তখন, বয়সভিত্তিক বলুন জাতীয় পর্যায় বলুন বা জাতীয় দল; সব খানেই দাপটের সাথে মাঠ মাতাচ্ছিলেন জলিসুর রহিমের রত্নরা।

স্যার বলছিলেন, “এখন তো কত সহজ সব কিছু। তখন তো এমন ছিল না। আমি খালি হাতে আমার ছেলেদের প্র্যাক্টিস করাইছি। গ্লাভস কিনার টাকা নাই।” এখন, ক্রিকেটের এই ভরা যৌবন দেখলে স্যারের কথাগুলো রুপকথার মত লাগে। ব্যাটও ছিল না তখন। বলেন, “আমরা একটা ব্যাটরেই অদল বদল কইরা খেলছি। ব্যাটও তো সবার ছিল না। যেইদিন ম্যাচ থাকত, যার ব্যাট ছিল সেই ভোর বেলায় গিয়া তার বাসার সামনে বইসা রইছি। যাতে, ব্যাট না দিয়া বের হয়া যাইতে না পারে। কষ্ট করতে হইছে অনেক”। স্বপ্ন আর সাধ্যের মধ্যে যখন আসমান জমিন ফারাক তখন পিছু হটে যাওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু, যে মানুষ শুধু ক্রিকেটের টানে ঘর ছাড়তে জানেন, তিনি এই স্বাভাবিক জিনিসটাকেই বা মানবেন কেন? তাই, স্বল্প রসদেই চলে যুদ্ধাস্ত্র তৈরীর কাজ, ফলও আসতে থাকে হাতেনাতে। সেসময়কার পাকিস্তানের কোচ ফারুক আহমেদের অধীনে বিসিবির বয়স ভিত্তিক খেলোয়াড়দের নিয়ে যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল তাতেও ছিল জলিসুর রহিমের ছয় রত্ন। এই ছয়জনকে তিনি বাসে নিয়ে যেতেন, তিনজনের সিটে চারজনকে বসিয়ে। টাকার অভাবে আটকে থাকেনি উদ্যম। দমে যাননি ফসল ফলাতে জানা এই রাখাল। তাই আশি থেকে নব্বই দশকের শেষার্ধ্ব পর্যন্ত ঢাকার ক্রিকেট বলুন কিংবা বয়স ভিত্তিক অথবা জাতীয় দল; সবখানেই সদর্পে বিচরণ করেছেনে জলিসুর রহিমের যোগ্য শিষ্যরা। সবচেয়ে বিরুপ এবং চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা বোধ করি ঘটেছিল জাহাঙ্গীর আলমকে তুলে আনার সময়। এই জাহাঙ্গীর আলমকে তুলে আনতে গিয়েই মুখোমুখি হয়েছিলেন পঞ্চায়েতর।

চটপটি বিক্রেতার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম তখন কাজ করতেন এক দোকানের দর্জি হিসেবে। টানাটানির সংসারে এই উপার্জনটুকু ছিলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু, তা বাদ দিয়ে জলিস স্যার যখন জাহাঙ্গীর আলমকে মাঠ মুখী করে তুললেন তাতে বাধ সাধলেন তার মা। জলিস স্যার বলেন ” উনারা ত তখন বুঝতেন না”। জলিস স্যার দমে যাননি। তিনি যে জাহাঙ্গীর আলমের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন অসামান্য প্রতিভা। নিজের অধীনে রাখার বদলে ভাবলেন আরো ভাল কোন জায়গায় অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেয়ার। সে চেষ্টার অংশ হিসাবে কথা বললেন ডালিম সাহেবের সাথে। ডালিম সাহেব বললেন, ব্রাদার্স ক্লাবে তো আমি আছি, এইখানে নিয়া আসো। কিন্তু, যাতায়াত করবে কেমনে? সে ব্যবস্থার উদ্যোগও নিজ কাধেই তুলে নেন স্যার। সেসময় নারায়ণগঞ্জের জিমখানা ক্লাব মাঠে নিয়মিত ফুটবল লিগ হতো। সে লিগের প্রতি দুই খেলায় রেফারীর ভূমিকা পালন করে পেতেন দশ টাকা। সেই টাকার একটা পয়সাও নিজের জন্য ব্যয় করেননি। বরং, খেলা শেষে সন্ধ্যা বেলায় পুরো টাকাটা তুলে দিতেন জাহাঙ্গীর আলমের বাবার হাতে, ঢাকায় যাতায়াতের খরচ হিসেবে। একদিন-দুদিন না, এভাবে চালালেন একটা বছর। যে বীজ থেকে ফসল ফলানোর জন্য এ প্রচেষ্টা, দিনশেষে তিনি কেমন করেছেন জানার আগ্রহ বোধ করি ইতঃমধ্যেই মনের মাঝে উকি মারতে শুরু করেছে। সেই দর্জি ঘরের কেঁচি ছেড়ে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে জাহাঙ্গীর আলম শুধু ঢাকার মাঠই মাতাননি, খেলেছেন জাতীয় দলেও। অংশ ছিলেন ইংল্যান্ড সফর করা প্রথম বয়সভিত্তিক দলেও। এতটুকুতেই থামেননি এ পরিশ্রমী ক্রিকেটার। ৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও ৯৯ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ দলে অংশ নিয়ে নিজের যোগ্যতার জানান দেন তিনি।

তিনি অবশ্য নিজের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার মানেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎকে। স্যারের ভাষায় যার ক্যালিবার ছিল আলাদা রকমের। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের বহু স্মরণীয় মুহুর্তের সাক্ষী এই ওপেনার। পাকিস্তানকে হারানো বিশ্বকাপের সে ঐতিহাসিক ম্যাচটিতে খেলেছিলেন ৩৯ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। ওপেনিং করেছেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্টেও। একদিনের ক্রিকেটে পাকিস্তান-বধের পর বহুটা সময় যখন হারের গ্লানিতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত বাংলাদেশ, প্রায় পাচ বছর পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আসলো বহু কাঙ্খিত সে জয়। সে ম্যাচটিতেও ছিলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। হয়তো, নিজের প্রতিভার প্রতি সে অর্থে সুবিচার করতে পারেননি। কিন্তু যা করেছেন তাতেই অক্ষয় হয়ে রইবেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে। হ্যা, বিবর্তনে বদলে গিয়েছে বহু রেকর্ড। কিন্তু, এখনও এক দিবসীয় ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওপেনিং রানের জুটি বিদ্যুৎ-অপির দখলে।

কথার সূত্র ধরে স্যারের কাছে জানতে চাই, আগে বলতে গেলে আপনি একাই ছিলেন, তারপরও ক্রিকেটাঙ্গনে নারায়ণগঞ্জের দাপট ছিলো চোখে পড়ার মত। এখন তো এত কোচ, এত একাডেমি, অথচ নারায়ণগঞ্জের খেলোয়াড় খুঁজতে গেলে রীতিমত আতশি কাচের সাহায্য নেয়া লাগে। এমনটা কেন? এখানে বর্তমান কমিটিরই বা দায় কতটুকু? প্রথমেই একটা ভুল ভাঙ্গিয়ে দেন স্যার; তিনি রাখাল, কোচ না। কোচ আর রাখালের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। রাখালরা যার মাঝেই সম্ভাবনা দেখেছেন শ্রম বিনিয়োগ করেছেন তার পেছেনে। জাহাঙ্গীর আলমের গল্পটা তার এক অনন্য উদাহারণ। কিন্তু, এখন সব পেশাদার।

বর্তমান কমিটিও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে খেলা মাঠে রাখার। লিগ নিয়মিত, নিয়মিত হচ্ছে স্কুল ক্রিকেটও। কিন্তু, ময়দান থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার জন্য যাদের উপর তারা ভরসা করছেন তাদের হালতও খুব যে ভাল নয়। গায়ে কোচের উর্দি তো আছেই, কিন্তু, যোগ্যতা নেই, নেই জলিসুর রহিমের মত রাখালেরা। তাই উর্বর এই জমিতে পর্যাপ্ত রসদ থাকার পরেও ঠিক মত ফসল ফলছে না। ধীরে ধীরে ক্রিকেটাঙ্গনে নারায়ণগঞ্জ হয়ে যাচ্ছে এক বিস্মৃতির নাম।

কথার এক ফাকে স্যারের কাছে জানতে চাই, যে ক্রিকেটের জন্য জীবন যৌবন উৎসর্গ করলেন, আপন ঘরে হয়ে গেলেন অচেনা অতিথি; সেই ক্রিকেট বোর্ড কোনো স্বীকৃতি দিয়েছে কি না? বর্তমান বোর্ড কর্তাদের গায়ের শ্যুট কোটের বাহারই বলে দেয় বর্তমানে ক্রিকেট বোর্ডের ব্যাংক ব্যাল্যান্স কিরুপ। চেহারাটায় কি একটু মেঘ নেমে আসে? সেটি বোঝার আগেই স্যার বলেন, “জানি না বোর্ড আমার সম্পর্কে কতটুকু জানে। ওখানে বোধ হয় লোক লাগে, আমার তো তেমন কেউ নাই।”

যার হাত ধরে বিদ্যুৎ, জাহাঙ্গীর, জাকারিয়াদের মত খেলোয়াড়ের জন্ম, তার নামই যদি বোর্ড না জানে তাহলে সেটিকে ঠিক কি বলা যায়। তবে, বোর্ডের স্বীকৃতির বিষয়ে অভিযোগ অনুযোগ কোনোটাই না করে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেটের বর্তমান হাল নিয়ে নিজের কষ্টের কথা। অভিমানে বেশ কিছু দিন দূরেও সরে ছিলেন। পরে, তাকে মাঠে ফিরিয়েছেন তারই শিষ্য নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ টিটু। কিন্তু, বয়সের ভারের সাথে অসুখের অনাকাঙ্খিত মিতালীর কারণে এখন আর মাঠ দাবড়ে বেড়াতে পারেন না। বরং, মাঠের এক কোণে বসে অসহায় তাকিয়ে দেখেন তিলে তিলে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের পতন। বলেন, এখনো সময় আছে, ভুল আমারও থাকতে পারে। কিন্তু, সবাই মিলে বসে একটা সমাধান বের করা উচিত। ময়-মুরুব্বি যারা আছেন তাদের কথা শোনা উচিত। কেননা, শেকড় ভুলে গেলে পতন হতে খুব বেশি সময় লাগে না।

স্যারের এই অসহায় অবয়বকে বড় অচেনা ঠেকে। ওসমানীর প্রতিটি ঘাস যার স্পর্শ দিয়ে দিন শুরু করত তারাও বোধ করি বোবা কান্নায় প্রতিবাদ জানায়। যার ফলে এই মাঠ থেকে আর ফসল ফলছে না। এখনো সময় আছে, জলিসুর রহিমদের মত যাদের হাত ধরে ক্রিকেটটা আজকে এই পর্যায়ে এসেছে তাদের যথোপযুক্ত সম্মান দেয়ার। নতুবা কে জানে? কালের গহবরে ক্রিকেটও তলিয়ে যাবে একদিন।

আলাপচারিতার মাঝেই স্যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সেই সময়কার রাইফেলস ক্লাবের কর্তা কুতুব উদ্দিন আকছির, রহমত উল্লাহ মহলসহ আরও অনেকের প্রতি। আমরা প্রায়শ বলি পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। কথাটা আংশিক সত্য। পশ্চিমাদের কাছ থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে আমরা বৃদ্ধাশ্রম নামক জেলখানা বানাতে শিখেছি। কিন্তু, শিখতে পারিনি সম্মান দেয়াটা। ইয়ান বোথামরা তো ইংলিশ ক্রিকেট মাতিয়েছেন বহুপরে, অথচ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ নাইট উপাধি পেয়ে বসে আছেন। অথচ সেখানে যাদের হাত ধরে আমাদের ক্রিকেটের জন্ম সেই জলিসুর রহিমরা অবহেলায় অভিমানে ক্রিকেট বাগানে বসে আছেন একলা, এক কোণে…