গত বছরে (২০১৭) নানা ধরণের অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায়। বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা দুনিয়ার পড়ুয়াদের মধ্যে যে সকল বই সবচাইতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, জবানের পক্ষ থেকে এমন ১০টি বই নিয়ে বিশেষ আয়োজন
১ দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেজ (The Ministry of Utmost Happiness)
কাশ্মীরের পক্ষে থেকে, নকশাল-মাওবাদীদের পক্ষে লিখে এবং বঞ্চনা-অত্যাচারের বিপক্ষে আওয়াজ তুলে সবসময় মাতিয়ে রাখেন সময়কে। লেখালেখিকে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নিয়ে ১৯৯৬ সালে প্রথম উপন্যাস লিখেন “গড অফ স্মল থিংস”,পরের বছরই সেটি বুকার প্রাইজ জিতে নেয়। তার দীর্ঘ বিশ বছর পর তিনি লেখেন তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেজ’, যেটি ২০১৭ সালে সবচেয়ে আলোচিত বই এর তালিকায় চলে আসে।
“শত্রুরা আমাদের লড়াইয়ের উদ্যম দমাতে পারে না, কেবল বন্ধুরাই পারে”
ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার অরুন্ধতী রায়ের এই উপন্যাসটিতে আধুনিক ভারতের নানা সংকট ও একে অপরের প্রতি হিংসা-দাঙ্গাকে সামনে আনা হয়েছে। ভারতে ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া গুজরাটের গোধরা স্টেশনে ট্রেনে আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে কাশ্মীর সংকট সবকিছুকে তিনি তার নিজস্ব ঢংয়ে উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসটিতে, যেখানে তার চরিত্রগুলোর ঘুরপাক মূলত দিল্লীকে কেন্দ্র করে। এই বইয়ে তিনি বলেন, “শত্রুরা আমাদের লড়াইয়ের উদ্যম দমাতে পারে না, কেবল বন্ধুরাই পারে”।
২. দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২ (The Qualition Years 1996-2012)
২০১৭ সালে ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতিতে শোরগোল ফেলে দেয়া বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২’। বইটির প্রণেতা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মূখার্জী। মূলত তার বর্ণিল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে তিনি এই বইতে তুলে এনেছেন। তবে এই বইটি বাংলাদেশে আলোচিত হয়, ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে প্রণব মুখার্জীর যোগাযোগ, বিশেষ করে সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা তিনি করেছেন বলে দাবী তুলেছেন। এবং তৎকালীন সেনাপ্রধানসহ আরও যারা কুশীলব তাদের বিচারের আওতামূক্ত রাখার পেছনেও তার হাত আছে বলে উল্লেখিত আছে। তিনি লিখেছেন, “এসময়ে ভারত সবসময় কেয়ারটেকার সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখত। … সেবার (জেনারেল মঈন উ আহমেদ) ছয়দিনের সফরে ভারতে এসেছিলেন। আমার সাথে বেশ আলাপ হয়েছিল। আমি জেলবন্দী নেতৃবৃন্দের মুক্তির ব্যাপারে বলেছিলাম।” ফলে ইতিহাসের দলিল হিসাবে ২০১৭ সালে এই বইটি বাজারকে বেশ চাঙা রেখেছিল। বইটি প্রকাশ করেছে ভারতের রূপা পাবলিশার্স।
“এসময়ে ভারত সবসময় কেয়ারটেকার সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখত। … সেবার (জেনারেল মঈন উ আহমেদ) ছয়দিনের সফরে ভারতে এসেছিলেন। আমার সাথে বেশ আলাপ হয়েছিল। আমি জেলবন্দী নেতৃবৃন্দের মুক্তির ব্যাপারে বলেছিলাম।”
৩. এইজ অফ অ্যাঙ্গার (Age of Anger-A History of the Present)
সমসাময়িক সময়ের যে-কয়জন নতুন তরুণ লেখক সবার নজর কেড়েছে ভারতের পংকজ মিশ্র তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে আছেন। ১৯৯১ সালের দিকে লেখালেখির সর্বোচ্চ প্রস্তুতির জন্যে তিনি হিমালয়ে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়ে পাঠকদের নজরে আসেন। বাটার চিকেন ইন লুধিয়ানা-ট্রাভেলস ইন স্মল টাউন ইন্ডিয়া (Butter Chicken in Ludhiana: Travels in Small Town India) নামের ভ্রমণ-কাহিনী প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি লেখালেখির জগতে আসেন। কাশ্মীর নিয়ে লিখছেন; Kashmir: The Case for Freedom। এবার ২০১৭ সালে বের হল, এইজ অফ এঙ্গার (Age of Anger)। এ-বইটি মূলত বিশ্লেষণী ধাচের, যেখানে তিনি একবিংশ শতাব্দীর নানা সংকট আইএস থেকে শুরু করে বিশ্বায়নের সংকট, নানা আন্দোলন এবং সেসব বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ মলাটবদ্ধ করেছেন। লন্ডনের লিটারেচার রিভিউ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানসহ অনেক জায়গা থেকে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে এফএসজিবুকস (FSGBooks) থেকে প্রকাশিত এই বইটি।
৪. দ্য গোল্ডেন হাউজ (The Golden House)
স্যাটানিক ভার্সেস খ্যাত সালমান রুশদি মানেই একঝুড়ি বিতর্ক। সেটি কখনো বই এর বিতর্ক, কখনো বা ধর্মের, কখনো বা নারী। উপন্যাস লিখে নিজের জীবনকে ফেলেছেন হুমকিতে। দ্য গোল্ডেন হাউজও সেই ধারায় নতুন আরেকটি সংযুক্তি।
এই বইটি মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। মূলত বারাক ওবামার শেষ সময় থেকে আজকের ট্রাম্পের শাসন, সব উঠে এসেছে এই বর্ষীয়ান সফল উপন্যাসিকের এই বইয়ে। বইটি প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ।
৫. দ্য রেড হেয়ার্ড উইমেন (The Red Haired Women)
এটি তুরস্কের নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের দশম উপন্যাস। উপন্যাসটি মূলত এক তরূণকে কেন্দ্র করে। লেখক হওয়ার আশা যার মনে-প্রাণে, তবে পরিবার তার চতুর্দিক দিয়ে বিধ্বস্ত। পিতা বামপন্থি রাজনীতিক হয়ে জেলবন্দি, পরিবারে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ; এভাবেই ঘটনা সামনে এগোয় তুরস্কের উইলিয়াম ফকনার-খ্যাত ওরহান পামুক। তুর্কি ভাষা থেকে অনূদিত বইটি প্রকাশ পেয়েছে পেঙ্গুইন থেকে।
৬. ম্যান উইদাউট উইমেন (Men Without Women)
নোবেল পাবে বলে সবচেয়ে বেশী আওয়াজ উঠেছে যাকে কেন্দ্র করে, টানা অনেকবার যিনি তালিকাতেও ছিলেন তিনি হচ্ছেন জাপানী ভাষার এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি (Haruki Murakami)। নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর এর মত বিখ্যাত উপন্যাস আছে তার ঝুলিতে। এই বছরে এসেছে তার ছোটগল্পের বই, ম্যান উইদাউট উইমেন। মূলত এই সময়ের পুরুষের যাবতীয় বিষাদ-বিচ্ছেদকে সামনে রেখে এই গল্পগুলো লিখেছেন গার্ডিয়ান-মতে জীবিতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম এই লেখক।
৭. এক্সিট ওয়েস্ট (Exit West)
এই বছর বের হয়েছে দ্য রিলাকট্যান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট-খ্যাত পাকিস্তান বংশোদ্ভূত লেখক মহসিন হামিদের বই এক্সিট ওয়েস্ট। গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাঈদ এবং নাদিয়া নামের এক দম্পতির জীবন কিভাবে আবর্তিত হয় সেটিই ফুটে উঠে এই উপন্যাসে। সিরিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করেছে টাইমস ম্যাগাজিন। তার প্রথম বই মথ স্মোক (Moth Smoke) নিউ ইয়র্ক টাইমসের বুক অফ দ্য ইয়ার-২০০০ সম্মাননা অর্জন করে। হার্ভার্ড ল স্কুল এর সাবেক ছাত্র মহসিন হামিদ নিজেও ফরেন পলিসির বিশ্বের উল্লেখযোগ্য শত-চিন্তকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন ২০১৩ সালে।
৮. দ্য ম্যাজিক ল্যাম্প (The Magic Lamp)
১৯৯১ সালে বুকার জয়ী নাইজেরিয়ার লেখক বেন ওকরির এই বইটি বের হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মূলত পঁচিশটি গল্পকে পঁচিশটি তৈলচিত্রের মাধ্যমে একটি মলাটে এনেছেন তিনি। এর আগে ব্যাপক আলোচিত উপন্যাস দ্য ফ্যামিশড রোড (The Famished Road) লিখে সবচেয়ে কম বয়সী বুকার অর্জনকারী হিসাবে নিজের নাম লেখান ওকরি। গত নভেম্বরে ঢাকায় লিট ফেস্ট এর আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই আফ্রিকান সাহিত্যিক।
৯. দ্য রিটার্ন (The Return)
২০১৭ সালের পুলিৎজার জয়ী বই দ্য রিটার্ন মূলত লিবিয়ান লেখক হিশাম মাতারের নিজের জীবনের কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা। কিভাবে লিবিয়ার স্বৈরশাসক গাদ্দাফী তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের জেলে পুরে দিতেন, নানা অত্যাচারের সম্মুখীন করতেন, তার পিতাও ছিলেন তাদের একজন। সেই সময়ের নিগ্রহ-বঞ্চনাকে ঘিরেই এই আত্ম-কথনমূলক বই। বইটিতে তিনি অনেক স্মৃতির অবতারণা করেছেন যেমন, “কবিতা-প্রেমী সেই লোকটির কথা আজো মনে পড়ে যিনি বলেছিলেন, একটি বই পড়া মানে বুকে একটি বসতবাড়ি নিয়ে ঘোরা” এটি পেন-আমেরিকান পুরষ্কারও জিতে নেয়।
“কবিতা-প্রেমী সেই লোকটির কথা আজো মনে পড়ে যিনি বলেছিলেন, একটি বই পড়া মানে বুকে একটি বসতবাড়ি নিয়ে ঘোরা”
১০. লিংকন ইন দ্য বারডো (Lincoln In the Bardo)
জর্জ সন্ডার্সের বুকার জয়ী উপন্যাস এটি। তিনি মূলত মার্কিন মুল্লুকের একজন অধ্যাপক এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানসহ নানা পত্রিকায় নিয়মিত নিবন্ধ লিখেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের পুত্র উইলিয়াম লিংকনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখা লিংকন ইন দ্য বারডো সন্ডার্সের প্রথম উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয়েছে ব্লুমসবারি পাবলিশিং, লন্ডন থেকে।