৯/১১ এর পরে পন্ডিতরা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আত্মহত্যা করেছিল: পঙ্কজ মিশ্র

৯/১১ এর পরে পন্ডিতরা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আত্মহত্যা করেছিল: পঙ্কজ মিশ্র

বর্তমান দুনিয়ার প্রগতি, জনপ্রিয় ইতিহাস এবং আমাদের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ও বিভক্ত বৈশ্বিক অবস্থা নিয়ে এটি একটি অতি দরকারি আলোচনা। ভারতীয় ঐতিহাসিক ও লেখক পঙ্কজ মিশ্র’র সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিখ্যাত পাকিস্তানি বিশ্লেষক রাফিয়া জাকারিয়া। তাঁর অনুমতিক্রমে লিটারারি হাব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত জরুরি এবং সাম্প্রতিক বিশ্ব ও বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক এই আলাপচারিতাটি জবানের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ এ. বাসেদ।

 

২০১৭ সালে ঐতিহাসিক ও চিন্তক পঙ্কজ মিশ্র’র ‘Age of Anger: A History of The Present’ নামে নতুন একটি বই প্রকাশিত হয়। যখন ঘৃণা বৈশ্বিক রাজনীতির অঙ্গনকে গ্রাস করে ফেলেছে। এমন সময়ের লেখা-লেখিকে ‘আবেগতাড়িত ইতিহাস’ বলে অাখ্যায়িত করেছেন তিনি। পঙ্কজ মিশ্র এই সময়টাকে ‘বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থার’ মুহূর্ত বলে চিহ্নিত করেন। বইটিতে সেইসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। মিশ্র আমাদের সময়কার বিশৃঙ্খল অবস্থাকে নীৎশে যাকে ‘Ressentiment’ নাম দিয়েছিলেন সে হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। বাংলায় এর সরাসরি প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে না কিন্তু নিৎসীয় চিন্তার সাথে মিল রেখে এটাকে আমরা বলতে পারি ‘আবেগসর্বস্ব বিদ্রোহ’। এ ধরণের অবস্থায় শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সমাজের একেবারে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মনে সৃজনশীল উপায়ে বিদ্রোহের মনোভাব তাতিয়ে ওঠে। মিশ্র দেখান যে, এই যে আবেগী বিদ্রোহের শক্তি এবং যে ধরনের বিক্ষোভ তৈরি হয় তা শেষ পর্যন্ত কোন পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে না। তবে এই ধরণের আবেগী বিদ্রোহ সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে প্রাণবন্ত রেখেছে, এবং এইসবকে কেন্দ্র করে গদ্যসাহিত্যে থেকে শুরু করে নানা রকম চটকদার সাহিত্যিক বয়ান তৈয়ার হইতেছে। এইসবের নানারকম নন্দনতাত্বিক প্রশংসাও এইসব প্রান্তীয় মানুষদের  ক্ষমতার স্বাদ থেকে কিভাবে দূরে রাখে তাও মিশ্র হাজির করেছেন। আবেগ ও অর্থহীন বিপ্লব প্রচেষ্টা এই শ্রেণীর মানুষদের কখনো বাস্তবের সাথে লড়াইয়ের উপযোগী করে গড়ে উঠতে দেয় না। এবং সমাজে জারি থাকা বৈষম্য ও বিভক্তিও দূর করা সম্ভব হয় না।

এই কিছুদিন আগেই যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত প্রথম আইন জারি করলেন এবং সেটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর নতুন আরেকটি আইন জারি হলো। তার মধ্যবর্তী বিরতিতে মিশ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে এসেছিলেন। আমাদের মধ্যকার আলাপের কিছুদিন পরেই প্রেসিডেন্টের নতুন বাজেট কার্যকর করা হয়। যেখানে Corporation for Public Brodcasting এবং National Endowment for the Arts এর সাথে সকল প্রকার সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হয়। মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বাজেট কমানো হয়। এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের বাজেট বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। এসব দেখে মনে হতেই পারে পৃথিবী আরও অনেক যুদ্ধ, ধ্বংস, উচ্ছেদ এবং শান্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মিশ্র এবং আমি Age of Anger বইটির পরিণামদর্শিতা এবং এই বইয়ে লেখক কিভাবে আমাদের এই ঘোলাটে এবং বিভক্ত বিশ্বব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন সেসব নিয়েই কথা বলেছি।

 

রাফিয়া জাকারিয়া: আপনার বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় বইটি লেখার ধাপগুলো সম্পর্কে জানা যায়, দেখা যাচ্ছে মোদীর নির্বাচন থেকে শুরু হয়ে ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে অবশেষে ট্রাম্পের নির্বাচনে এসে বইটি শেষ হয়েছে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রার একেবারে শুরুতে যখন ছিলেন, তখন যেসকল বই এবং রাজনীতির যেসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা লাগতে পারে তা কি আপনি আগেভাগেই দেখতে পেয়েছিলেন ?

পঙ্কজ মিশ্র: ইস আমি যদি সেরকম কোনো পূর্বাভাস পেতাম! আমি জানতাম যে ইউরোপে যা হচ্ছে খুব ভুল ভাবে হচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসমতার ব্যাপারটি একটি ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমি জানতাম না যে ব্রেক্সিট বাস্তবায়িত হবে কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে যাবে। আমি কেবল ধারণা করেছিলাম যে অনেকেই তাকে ভোট দেবে। কিন্তু আমি এটাও আশা করেছিলাম যে নিশ্চয়ই এত মানুষ এই কাজ করবে না। যার ফলে একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ এবং হোয়াইট হাউজের জন্য তামাশারুপে আবির্ভূত একজন লোককে তারা নির্বাচিত করে ফেলবে। অবশ্যই বইটি লেখার সময় আমার মাথায় বিক্ষোভের ঘটনাগুলো ছিল। কিন্তু সেসবের রাজনৈতিক ফলাফল ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।

জাকারিয়া: নাইন-ইলেভেনের পর একটি ধারণা জন্মেছিল যে সন্ত্রাসবাদ মানেই ইসলাম এবং মুসলিম জাতি। আপনার বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম হচ্ছে এই ধারণাটিকে বাতিল করা। আপনি লিখেছেন, “সেসকল ইসলাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা যারা নাইন-ইলেভেনের পর তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন তারাই প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার পর তাঁদের বেসাতিগুলোকে আরও নিকৃষ্টভাবে ব্যবহার করছেন।” এই বিশেষজ্ঞরা আসলে কারা, এবং তাঁদের চর্চাগুলোয়  তারা যাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলছেন তাঁদের জন্য আপনি ঠিক কতটুকু হুমকি বলে মনে করেন?

মিশ্র: আমরা, এবং এখানে আমরা বলতে আমি বুঝাচ্ছি আমরা যারা বুদ্ধিজীবী মহলের অংশ তারা ‘সন্ত্রাসের মূল ইসলামে প্রোথিত’ আখ্যা দিয়ে এবং ‘ইসলামের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মাঝে কিছু অদ্ভুত বিষয় আছে যা সন্ত্রাসের উদ্ভাবক’ কথাটি বলার মধ্য দিয়ে অনেক বড় একটি ভুল করেছিলাম। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সন্ত্রাসবাদের মিশ্র ইতিহাসের দিকে তাকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর তাই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বার্মা, থাইল্যাণ্ড কিংবা ভারত সবখানেই বেশকিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণের সম্মিলনের ফলেই সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটছে। এটি হচ্ছে হতাশা এবং যন্ত্রণার একটি প্রকাশভঙ্গি। ‘ভঙ্গিটি ইসলাম থেকে এসেছে’ এই ধারণাটি একটি ভয়ঙ্কর ধারণা। এবং শুধুমাত্র কট্টর ডানপন্থীরা যারা আজকে পলিসি নিয়ন্ত্রণ করছে তারা নয়। বরং লিবারেল বুদ্ধিজীবী মহল থেকেও এই ধারণাটিকে মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং বৈধতা দেয়া হয়েছিল।

 

নাইন-ইলেভেনের পর একটি ধারণা জন্মেছিল যে সন্ত্রাসবাদ মানেই ইসলাম এবং মুসলিম জাতি। আপনার বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম হচ্ছে এই ধারণাটিকে বাতিল করা

 

প্রথমেই মনে পড়ে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার কথা যিনি বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে ইসলামের মাঝে বেশ কিছু অন্তর্নিহিত বিষয় আছে যা আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়ার অযোগ্য। এরপর আছেন সালমান রুশদী। এমনকি মার্টিন আমিসের মতো লোক যারা গণহারে মুসলমানদের পশ্চিম থেকে ফেরত পাঠানোকে চিন্তা-গবেষণার একটি অংশ বলে সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি দিয়েছিলেন। এককথায়, প্রায় সকল প্রকার মূলধারার ব্যক্তিত্বরাই এই ইসলামোফোবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে লালন করেছেন। একই সাথে প্রচণ্ড ঘৃণ্য এবং ভয়ংকর উপায়ে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষাদান, ইসলামকে বুঝা এবং মডারেট মুসলিমদেরকে সাহায্য করার বাহানায় তুলে ধরছিলেন তাদের বাজে সব চিন্তা-ভাবনা। এ কারণেই আজ আমরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি।

তাই, এখন যখন দেখি, গোঁড়ামি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালিত করছে আর সবচাইতে বড় গোঁড়া ব্যক্তি হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর সাথে ইসলাম কিংবা খ্রিস্টান ধর্মের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এখানে আমরা একটি গোটা ইন্টারপ্রেটিভ প্যারাডাইমকে বাতিল হয়ে যেতে দেখছি। যা পৃথিবীকে বুঝবার একটা পুরোপুরি ব্যর্থ উপায় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের এমন একটা ব্যাখ্যা দরকার, যা আজকের গোঁড়াপন্থিদের, যেটা তারা মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান কিংবা ইহুদী আগ্রাসনবাদী যেই হোক না কেন, তাদের মাঝে একটা পার্থক্য হাজির করতে সক্ষম হবে। যা প্রমাণ করবে যে, নারী-বিদ্বেষ ও বিরোধিতা এবং মাল্টিকালচারালিজমের অভাবের দিক দিয়ে এই প্রতিটি সম্প্রদায়ই প্রায় একই কাতারের। যেসব বিষয় তাদেরকে একত্রিত করে। যেমন: গোলযোগপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তন, মানসিক বিকৃতি, অবহেলা ও অপমানবোধ সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

আমি সবেমাত্র মিয়ানমার থেকে ফিরেছি। যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গোষ্ঠীগত গণহত্যাকারীতে পরিণত হয়েছে। আমি বুদ্ধিজমের মূলকথার সাথে তাঁদের এই কাজের সম্পর্ক দেখানোর ব্যাপারে যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে পারব। এরকম কোনো সম্পর্ক পাওয়া যাবে না কারণ পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে সামাজিক-অর্থনৈতিক। ভিক্ষুদের মধ্যে অনেক বড় একটা অংশ মনে করে যে, একটি বৈশ্বিক, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির মাঝে তাঁদের ক্ষমতা নিহিত আছে। কিভাবে বৌদ্ধ ধর্মানুসারীরা সন্ত্রাসীতে রুপান্তরিত হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে হলে আপনাকে সেটা আগে বুঝতে হবে। নাইন-ইলেভেনের ঠিক পরপরই ‘ইসলাম হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জনক’ ভাবার মধ্য দিয়ে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে আত্মহত্যা করে বসি।

 

জনগণ অনেকবার মূর্খের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জনগণের ইচ্ছা আমাদেরকে দূর্যোগের পথে নিয়ে যেতে পারে। আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম ধ্বংস করে ফেলার বিরুদ্ধে একজন মানুষের যতটা সক্রিয়ভাবে পারা যায় প্রতিরোধ করা উচিত

 

 

জাকারিয়া: আপনার বইটি হচ্ছে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস নিয়ে। এমন একটা সময়ে  কাজটি হাজির হল, যখন মানুষ ইতিহাসের প্রতি বেখেয়াল কিন্তু বিকৃতি এবং পুনঃপাঠে উৎসাহী। আপনার  কি মনে হয়, জনপ্রিয় ইতিহাসকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের সক্ষমতা রয়েছে?

মিশ্র: আমি নিজেকে একজন বুদ্ধিজীবী-ঐতিহাসিক হিসেবে দেখি না। আমার বইটি যদিও কিছু কাঠামো অনুসরণ করেছে। কিন্তু বইটি লেখার সময়ে সত্যিকার অর্থে আমি আবেগ, মানসিকতা এবং এই আবেগ থেকে যে ধারণাগুলো জন্ম নেয় সেগুলোর উপরেই চিন্তা করেছি। আমার যুক্তি হচ্ছে, কিছু বিশেষ ধরণের অবস্থায় আমরা প্রায় সব মানুষকে একই রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেখি। যা এক ধরণের গোত্রতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রকট করে তোলে। আপনি এই ধরণের চর্চাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বার বার দেখতে পাবেন। আর তাই আমি একটি  আবর্তনমূলক কাঠামোকে ব্যাখ্যা করেছি। যা আসলে ‘ধারণা’ এবং ‘বিশ্বাস’ নির্মাণের কাঠামো সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করে।

আর হ্যাঁ, আমি এই ধরণের আবেগতাড়িত ইতিহাসকে জনপ্রিয় ইতিহাসের মোকাবিলায় যথার্থ হাতিয়ার বলে মনে করি। আমরা যে দেশের নাগরিকই হই না কেন। আমরা সবাই জানি যে, একটি সুনির্দিষ্ট দেশকে ভালোবাসা মানে পৃথিবীর বুকে নিজের এবং নিজের দেশের অবস্থানকে একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। যদি আপনি ব্রিটিশ হন। তাহলে আপনি বলছেন যে আপনি একটি সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের উপরে একদা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আর আপনি যদি ভারতীয় হন। তাহলে আপনি বলছেন হিন্দুরা কতো ভাল ছিল এবং মুসলমানরা কতটা ধোঁকাবাজ ছিল। জনপ্রিয় ইতিহাস রাজনৈতিক কল্পনার জগত কায়েম করে বসে। এবং এটি তখনই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যখন তা আমাদেরকে বৈশ্বিক এবং ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো নিয়া গভীর ভাবে চিন্তা করার পথে বাধা দেয়।

 

প্রগতির পেছনে ধাবিত হওয়া চরম মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দিতে পারে, এবং প্রতিযোগিতা, লোভ, প্রগতির আকাঙ্খাসহ এইরকম যেসব বিষয়গুলোকে আমরা মূল্যবোধ বলে জানি এগুলোর প্রত্যেকটিরই একটি অন্ধকার দিক রয়েছে

 

 

জাকারিয়া: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পের মতোই একইরকম বিভক্তি সৃষ্টিকারী পপুলিজমের কাঁধে ভর করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভারত কিংবা ভারতের সুশীল সমাজ মোদীকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে কি ধরণের ভুল করেছিল এবং আমেরিকান সুশীল সমাজ এ থেকে কি ধরনের শিক্ষা নিতে পারে?

মিশ্র: বেশ কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে আমাদের সতর্কদৃষ্টি রাখা উচিত। বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে লিবারেল বা উদারনীতিবাদি বুদ্ধিজীবীরা। যারা সব ঘটনাকেই একটি স্বাভাবিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। এবং জনগণকে সুস্থির হয়ে সেটেল হয়ে যেতে বলে থাকেন। যারা বলেন ‘জনগণ এই লোকটিকে নির্বাচিত করেছে এবং আমাদের জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কেননা জনগণের রায় অলঙ্ঘনীয়’, তাঁদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আমি এই ধারণার বিরোধিতা করি। ইতিহাসে দেখা গেছে, জনগণ অনেকবার মূর্খের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জনগণের ইচ্ছা আমাদেরকে দূর্যোগের পথে নিয়ে যেতে পারে।

আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্ম ধ্বংস করে ফেলার বিরুদ্ধে একজন মানুষের যতটা সক্রিয়ভাবে পারা যায় প্রতিরোধ করা উচিত। ভারতে মোদী আলোচনা-দ্বন্দ্ব-তর্ক-বিতর্কের প্রায় সকল পথই বন্ধ করে দিয়েছেন। আমেরিকান সমাজেও এটি লক্ষণীয় যেহেতু National Endowment for the Humanities and Other Arts এর সংস্থাগুলোকে ট্রাম্প প্রশাসনের আওতায় প্রচুর পরিমাণে ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও যখন কোন প্রশাসন এইসকল স্বাধীন স্পেসকে অবহেলা করতে শুরু করবে তখন বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি দেখতে হবে। যেমনটা আরেন্ট বলেন ‘এই মুহূর্তে রাজনীতিকে একটি জীবনধারায় পরিণত হতে হবে। প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে কমিউনিটি গড়ে তুলতে হবে। যারা আমাদের মাঝে অস্তিত্ব এবং সত্যের একটি অনুভূতি সৃষ্টি করবে।’ একটি সেমি-ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিপক্ষে আমরা একা লড়াই করতে পারি না।

 

জাকারিয়া: আপনার বইয়ের পরিশেষে থোরেওর একটি সুন্দর উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। থোরেও যখন জীবিত ছিলেন এবং লেখালেখি করতেন, সেই সময়টাও একটা বিক্ষুব্ধ সময় ছিলো: আমেরিকার ট্রান্সেডেন্টালিস্টদের আদর্শ, বিজ্ঞান এবং প্রগতিতে তাঁদের বিশ্বাসকে আমেরিকান সিভিল ওয়ার নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। আপনি কতটুকু মনে করেন যে, এই মানব মূহুর্তগুলো চক্রাকার, এবং এই ঘটনাগুলো আদর্শ থেকে ক্ষোভ বা অসন্তোষ তৈরি করে, আর সেই ক্ষোভ থেকে নির্মূল করে দেয়া এবং পুনরায় নতুন কোন আদর্শে ফিরে আসার  ব্যাপারটি অদম্য গতিতে এবং অনাদিকাল থেকে চলমান রয়েছে?

মিশ্র: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটি বিষয়ের একেবারে মর্মমূলটা স্পর্শ করতে পেরেছে। আমরা মনে করি প্রগতি ঐতিহাসিক বাস্তবতা মেনে চলে, কিন্তু আসলে তা নয়। প্রগতি ঘটে যায়, এর গতিপথ খুবই বেমানান এবং অনিয়মিত এবং অনেকগুলো ঘটনার মিশ্রণ। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেই নারী অধিকারের উন্নতি ঘটেছে এবং চীনে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারই নারী অধিকার কায়েম করেছে- এ ধরনের বেশ কিছু প্যারাডক্স আছে। আমি বুঝাতে চাইছি যে আমাদেরকে এজেন্সি কিংবা উচ্চাশার দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে একটি বোঝাপড়া সৃষ্টি করতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, প্রগতির পেছনে ধাবিত হওয়া চরম মাত্রায় সহিংসতার জন্ম দিতে পারে, এবং প্রতিযোগিতা, লোভ, প্রগতির আকাঙ্খাসহ এইরকম যেসব বিষয়গুলোকে আমরা মূল্যবোধ বলে জানি এগুলোর প্রত্যেকটিরই একটি অন্ধকার দিক রয়েছে।দার্শনিকভাবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে আমরা নিজেদেরকে অত্যন্ত একরৈখিক মস্তিষ্কের অধিকারী করে ফেলেছি, যার পরিবর্তন জরুরি।Pankaj-Mishra-Age-of-Anger

 

জাকারিয়া:যতদূর আমি জানি এটি হচ্ছে ইলেকশনের পরে আপনার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ। কোন কোন বিষয়ে পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?

মিশ্র: আমি দেখতে পাচ্ছি আমেরিকা একটি আসন্ন দূর্দশার কিনারে দাঁড়িয়ে আছে এবং আমার অন্যান্য ভ্রমণের চাইতে এই ভ্রমনটি অধিক পরিপূর্ণ। আমি একের পর এক মানুষের দেখা পাচ্ছি যাদের জীবন চরম মাত্রায় উপনিত হয়েছে এবং যারা আমেরিকা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে কারণ তারা মনে করছে তারা আর কখনো ফেরত আসতে পারবে না। অন্য যাদের এই ধরণের ভয় নেই তারাও চিন্তিত কারণ তারা মনে করে দেশটির মানবিক মূল্যবোধের অবনতি ঘটছে। আমার আমেরিকা ভ্রমণের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে এ ধরনের লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে, এবং আমার এই বইটি এ সকল ধারণা সম্পর্কে  ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু ঘটনাপ্রবাহ সরবরাহ করছে।

 

[ রাফিয়া জাকারিয়া হচ্ছেন The Upstairs Wife: An Intimate History of Pakistan বইয়ের লেখক, যেটি ২০১৫ সালে নিউজউইক পত্রিকার প্রথম দশটি নন-ফিকশন বইয়ের একটি হিসেবে সিলেক্টেড হয়েছিলো। তিনি পাকিস্তানের ডন পত্রিকার নিয়মিত কলামিস্ট, পাশাপাশি তিনি দি বোস্টন রিভিউ পত্রিকাতেও নিয়মিতভাবে Reading Other Women নামক সিরিজ লিখে থাকেন। তার লেখালেখি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ, দ্য নিউ রিপাবলিক, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, ডিসেন্ট, গুয়ের্নিকাসহ পৃথিবীজুড়ে আরও অনেক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার পরবর্তী বই Veil  এবছরই (২০১৭) ব্লুমসবেরি পাবলিকেশন্স থেকে বের হবে। ]