লিবিয়ান লেখক হিশাম মাতার ‘The Return’ নামক স্মৃতিচারণ গ্রন্থের জন্য এই বছর (২০১৭) Biography or Autobiography ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। লেখককের সাম্প্রতিকতম এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয় ১৭ মার্চ ২০১৭ তারিখে। সাহিত্য, বইপড়া ও ক্ষমতার বিষয় নিয়ে ছোট এই লেখায় অনেক কৌতুহলী মতামতের অবতারণা করেছেন তিনি। বাংলাদেশে এই লেখক একদমই পরিচিত নন। এই প্রথম তাঁর লেখা বাংলায় অনুবাদ হল। লেখাটি জবানের জন্য তর্জমা করেছেন মুহাম্মদ এ. বাসেদ।
যখনই আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন, তারা আমাকে বলতেন “পড়ো বিশ্বকে জানার জন্য।” এবং এটা সত্য, বইয়ের জগত আমাকে বিভিন্ন দেশে, মানসিক অবস্থায়, সামাজিক প্রেক্ষিতে এবং ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, বই আমাকে সবচেয়ে অস্বাভাবিক জনসমাবেশগুলোতেও একটা জায়গা করে দিয়েছে।
আমি আমার নিজের ভেতরের অগনিত কুঠুরিতে বিচরণের ফুরসত পেয়েছি, চমৎকার সব আলোচনা শুনতে পেরেছি আর এসবের মধ্য দিয়ে অন্য মানুষের অভ্যন্তরীণ জীবনের অতি সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পেরেছি। বই আমাকে আতঙ্ক এবং সৌন্দর্য দুটোই দেখিয়েছে। এই সবগুলো কথাই সত্য।
এমন কতবার হয়েছে যে আমাদের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন উপায়ে আমরা নিজেদেরকে আচমকা একজন রাশিয়ান, জাপানিজ কিংবা ফরাসি হিসেবে খুজে পেয়েছি? ঠিক কতবার আমরা বই পড়তে গিয়ে একজন কৃষক কিংবা অভিজাত মানুষের ভূমিকায় ছিলাম? ঠিক কতবার একটি বইয়ে আমরা একজন নারীর ভূমিকায় ছিলাম? তার ইয়ত্তা নেই। আমরা একইসাথে মুক্ত ও পরাধীন
কিন্তু, বই পড়ার সময় সবচাইতে জাদুকরী মুহূর্তগুলো অজানাকে জানার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না, এটা হয় যখন পড়তে গিয়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। যখন আমি এমন একটি বাক্য পড়ি যা আমার বহুদিন ধরে জানা বা অনুভব করা কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করে। এরকম মুহূর্তগুলো আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমি অন্যদের চাইতে খুব বেশি আলাদা কেউ নই।
মনে হয়, এটাই প্রত্যেকটা পাঠাগারের অন্তনিহিত উদ্দেশ্য: অন্যদের জীবন, পরিবেশ ও বয়ানের মাঝে নিজেদেরকে খুঁজে পাওয়া। এবং একটি বইয়ের গঠন যতো অজানা বিষয়কে ঘিরে গড়ে ওঠে, সেই বইয়ে বর্নিত ঘটনাটিকে ততটাই তীক্ষ্ণ বলে মনে হয়। এরকম মুহূর্তে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেঃ প্রথমে এক ধরণের দূরত্ব তৈরি হয় এবং পুনরায় সেই দূরত্ব কমে আসে।
এমন কতবার হয়েছে যে আমাদের অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন উপায়ে আমরা নিজেদেরকে আচমকা একজন রাশিয়ান, জাপানিজ কিংবা ফরাসি হিসেবে খুজে পেয়েছি? ঠিক কতবার আমরা বই পড়তে গিয়ে একজন কৃষক কিংবা অভিজাত মানুষের ভূমিকায় ছিলাম? ঠিক কতবার একটি বইয়ে আমরা একজন নারীর ভূমিকায় ছিলাম? তার ইয়ত্তা নেই। আমরা একইসাথে মুক্ত ও পরাধীন মানুষ হয়েছি, একজন সমকামী, পঙ্গু, বৃদ্ধ, ভালোবাসার মানুষ এবং ঘৃনার মানুষ হয়েছি- এই বই পড়তে যেয়ে।
প্রত্যেকটি মহৎ শিল্পই আমাদেরকে আমাদের সাধ্যের উপরে চোখ বুলানোর সুযোগ দান করে। এই শিল্পগুলোর কোনোটিই ‘ভার্চুয়াল বাস্তবতায়’ আনন্দ পাওয়া, চিনতে না পারা কিংবা কৌতুহলী হওয়ার মতো বিষয় নয়। এগুলো হচ্ছে বাস্তব অভিব্যক্তির মুহূর্ত। এরা আমাদের মানবতার কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করে। আমাদের ভবিষ্যত এইসকল শিল্পের উপরে নির্ভরশীল। আমরা তাদেরকে ছাড়া আজ এখানে অর্থাৎ বর্তমান পৃথিবীতে আসতে পারতাম না।
একটি নদী যেমন একটি সাগরে গিয়ে মেশে- ঠিক তেমনি জেইন অস্টিনের স্বদেশী সামাজিক হালহকিকত থেকে উইলিয়াম ফকনারের আমেরিকান সাউথ, নাগিব মাহফুজের কায়রো থেকে তায়েব সালিহের সুদানের গ্রাম- প্রত্যেকটি মহৎ সাহিত্যকর্ম সর্বদাই বৈশ্বিক পরিসরে অবগাহন করেছে।
সাহিত্য চরিত্রগতভাবেই নিজেদের সত্তার দিকে বার বার ফিরে যেতে চাওয়া নারী এবং পুরুষদের মধ্যকার দন্দ্বগুলোর দিকেই আগ্রহী, সাহিত্য সন্দেহ এবং পরস্পর বিরোধিতায় আগ্রহী। এইজন্যেই রাতের আকাশে চাঁদ যেমন আলো বিলায়, ঠিক তেমনিভাবেই কোনোরকম উদ্দেশ্য ছাড়াই সাহিত্য স্বৈরতান্ত্রিক ন্যারেটিভকে বাধাগ্রস্থ করে
সম্ভবত এই কথাটিই The House of Hunger উপন্যাসের জিম্বাবুইয়ান লেখক Dambudzo Marechera বলতে চেয়েছেন “যদি তুমি একটি নির্দিষ্ট দেশ বা সম্প্রদায়ের জন্য লিখে থাকো”, তাহলে এমন লেখকের আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এথানে তিনি এক ধরনের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার কথা বলছেন- যা আমাদের একাডেমিক পরিসরে এবং পাবলিক ডিসকোর্সে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে, যা একজন ব্যক্তির জীবনকে প্রথমে এবং প্রধানত একটি সুনির্দিষ্ট সম্প্রদায়, ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক ক্যাটাগরির প্রতিনিধি হিসেবে দেখে। তিনি সেটার প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছেন।
এর বিনিময়ে জনাব মারেচেরা একটি সাহসী বৈশ্বিকতাকে প্রমোট করতে চেয়েছেন যেটি আমার মতে সাহিত্যের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প, মারিন লা পেন, গার্ট উইল্ডার্স এবং নাইজেল ফারাজের মতো ডানপন্থী পপুলিস্টদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি না বা কোনো না কোনো দিক দিয়ে আমাদের মাঝে নেই এমন কোনো অনুভবই আমরা যা পড়ি তা আমাদেরকে দিতে পারে না। মার্সেল প্রাউস্ট তার Time Regained বইয়ে যেমনটি বলেছেন, “প্রত্যেক পাঠক হচ্ছে আসলে তার নিজেরই পাঠক।” অজানা কোনো অনুভূতি কিংবা আগ্রহই বই আমাদের মাঝে অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারে না। বই যা করতে পারে তা হলো- এটি আমাদের আবেগী, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের উন্নতি ঘটাতে পারে, এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা সবাই কিভাবে এবং কতটুকু পর্যন্ত একজন আরেকজনের সাথে জড়িত- সেটা দেখিয়ে দিতে পারে।
এইজন্যই সাহিত্য হচ্ছে মানবজাতির বৈশ্বিক চরিত্রের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ যুক্তি, এবং এই কারণেই সাহিত্য তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আপসহীন। এটি বশ্যতা মেনে নিতে নারাজ, একটি প্রজেক্ট যতোই মহৎ কিংবা গুরুতর হোক না কেন, একে নিয়ন্ত্রণ করাও যায় না, নির্দেশনাও দেয়া যায় না। সাহিত্য চরিত্রগতভাবেই নিজেদের সত্তার দিকে বার বার ফিরে যেতে চাওয়া নারী এবং পুরুষদের মধ্যকার দন্দ্বগুলোর দিকেই আগ্রহী, সাহিত্য সন্দেহ এবং পরস্পর বিরোধিতায় আগ্রহী। এইজন্যেই রাতের আকাশে চাঁদ যেমন আলো বিলায়, ঠিক তেমনিভাবেই কোনোরকম উদ্দেশ্য ছাড়াই সাহিত্য স্বৈরতান্ত্রিক ন্যারেটিভকে বাধাগ্রস্থ করে। আমাদের মানবচরিত্র সম্পর্কে সাহিত্য যা প্রকাশ করে তাই আজ আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্ত হয়ে উঠেছে।
দৃশ্যত জনাব ট্রাম্পের জীবনে সন্দেহ এবং পরস্পর বিরোধিতার কোনো সুযোগ নেই। আসল ব্যাপার তা নয়, যতো গভীরভাবেই গোপন করে রাখা হোক না কেনো অন্য সবার জীবনের মতো তার জীবনেও এই দুটি উপাদান হাজির। যে আবহ তাকে সর্বদা ঘিরে রাখে, তার চলার ভঙ্গি, তার মুখে অঙ্কিত রেখা, এক্সিকিউটিভ অর্ডার সাক্ষর করার সময়ে তার ঘাড়ের শক্ত হয়ে যাওয়া- এগুলোর মধ্য দিয়ে আপনি তার জীবনে উপরোক্ত দুটি বিষয়ের সন্ধান পাবেন। আর হ্যাঁ, তার জীবনে সন্দেহের অস্তিত্ব থাকতেই হবে, কারণ জটিলতার প্রতি তিনি কেবল অসহিষ্ণুই নন, তিনি একে প্রচন্ড রকমে ভয়ও পান।
তা না হলে প্রাণশক্তির অন্য কী মিথ্যাবস্তু তাকে সম্প্রদায় এবং ধর্মের ভিত্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দানবীয় রুপে হাজির করতে এবং অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বহিষ্কার করতে প্রেরণা যোগাচ্ছে? এটা একটা সেন্সর বোর্ডের মত যা কিনা সাধারণ পাঠককে অবজ্ঞা করে এবং বোঝায় যে জনাব ট্রাম্পেরও নিজের কাছে মানবতা সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। সেন্সরের মতোই, তার কাজগুলো তার নিজের সমাজের কোষগুলোকেই একটা পর্যায়ে ধ্বংস করে দেবে, কারণ আদতে যাদেরকে বহিষ্কার করা হয় তাঁদের চাইতে যারা বহিষ্কার করে তাঁদের উপরেই এই প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট ক্ষতির সত্যিকারের বোঝাটা পতিত হয়।
[লেখকের দুটি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘In The Country of Men’ ২০০৬ সালের বুকার পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তিনি নিয়মিত The Guardian, The Independent, The Times, The New York Times ইত্যাদি পত্রিকায় লিখেন।]