সাম্প্রতিক সময়ের বিবদমান এবং কলহপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ভয়ঙ্কর সব নির্বাচনী অপরাধের দেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি স্বাভাবিক ভাবেই নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পূর্বশর্তও এটি।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের নয়-ছয় মানে, অব্যবস্থাপনা, অর্থ লোপাট কিংবা হীন ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দীতায় লিপ্ত দুই গ্রুপ বা ব্যক্তির মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেয়ার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে করতে জনগণ এখন নিরুপায়। নির্বাচনের মৌসুম আসলেই এইসব প্রমাণিত লুটপাটকারীদের ঘিরেই একটা উম্মাদনা দেখা যায়, বহুবার এই একই সেন্সলেস ধরণের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকরা এখন ক্লান্ত। আমরা দেখেছি, সর্বশেষ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া দলটি সবসময়ই বহুগুণে প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটে কোন কার্পণ্য করেনি। আর এখনকার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থনীতিকে পঙ্গু করার রাষ্ট্রীয় প্রবণতা যেন প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। অবস্থা কত চরমে নেয়া যায় তার প্রতিযোগিতা চলছে চারদিকে। তবে সব কিছুর মধ্যে জনগণ যেন নিরব দর্শকই হয়ে থাকছে। তাই মন্দের ভাল বেছে নেওয়ার এই লজ্জাজনক খেলার সমাপ্তি দরকার। দরকার একটি মৌলিক পরিবর্তন।
বর্তমানের ইভিএম মেশিনে ভোট দেয়া হয় কাগজ ছাড়া। ভোটার নম্বর ধরে ধরে বিভিন্ন প্রতীকের বিপরীতে এসাইন করা কোডে ভোট দিবার মেশিন হল ইভিএম। এটা প্রশাসনিক জালিয়াতি বা জালিয়াতির ইচ্ছার বিপরীতে একবারেই প্রোটেকশনহীন। এই সময়ের ভোট ভিত্তিক দুর্বৃত্তপনার বিপরীতে এটা নিতান্ত অনিরাপদ তো বটেই এর ব্যবহারে একই সাথে নাগরিকদের ভোটাধিকার চরম ঝুঁকিতে পড়বে। যারা খামাখা যন্ত্রের যাদুকরীতে মুদ্ধ হয়ে ইভিএম নিয়ে মাতামাতি করছেন জানি না, তাঁরা এই দিকগুলো ভেবে দেখেন কি না
ভোট গ্রহণ পদ্ধতির সংস্কার তাই বহু জরুরি বিষয়ের মধ্যে অগ্রাথিকারযোগ্য একটি প্রসঙ্গ। বিগত বছরগুলোতে ইভিএম এর (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশে এটা গর্ব করার মত আবিস্কার হতে পারত আমাদের তরুণ প্রকৌশলীদের জন্য। কিন্তু সমস্যা হল, এটা আসলে উন্নত আইন শৃঙ্খলা ও নাগরিক মর্যাদা সমুন্নত আছে এমন দেশে খুব ভাল কাজ করলেও, আমাদের জন্য একই ফল বয়ে আনবে না। যেখানে, বল প্রয়োগে অন্যের ভোট জোর করে দিয়ে দেওয়ার বা ভোটের আগের রাতে ক্যাডার দিয়ে ব্যালট ছিনতাই করে সীল মারার মত অপরাধ ঘটে সেখানে এই পদ্ধতির সুবিধা জনগণের পক্ষে যাবার কোন সুযোগ নাই। আমাদের দেশের সোনার ছেলেরা নির্বাচনের আগের রাতেই ভোটার নম্বর ধরে ধরে ইলেকট্রনিক মেশিন দিয়ে ভোট দিবার গুরু দায়িত্ব নিজেরাই খুব দ্রুত সেরে নিবে। দেখা যাবে ইভিএম হলে কষ্ট করে আর ম্যানুয়ালি সিল মারতে হচ্ছে না। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে চুরির সুবিধাটা অনেক কষ্ট কমিয়ে দিবে। আরও আনন্দের সংবাদ হল, এটা ব্যালট সিলের মত না তাই সাংবাদিকরাও রিপোর্ট করার রেফারেন্সও সহজে খুঁজে পাবেন না।
বর্তমানের ইভিএম মেশিনে ভোট দেয়া হয় কাগজ ছাড়া। ভোটার নম্বর ধরে ধরে বিভিন্ন প্রতীকের বিপরীতে এসাইন করা কোডে ভোট দিবার মেশিন হল ইভিএম। এটা প্রশাসনিক জালিয়াতি বা জালিয়াতির ইচ্ছার বিপরীতে একবারেই প্রোটেকশনহীন। এই সময়ের ভোট ভিত্তিক দুবৃত্তপনার বিপরীতে এটা নিতান্ত অনিরাপদ তো বটেই এর ব্যবহারে একই সাথে নাগরিকদের ভোটাধিকার চরম ঝুঁকিতে পড়বে। যারা খামাখা যন্ত্রের যাদুকরীতে মুদ্ধ হয়ে ইভিএম নিয়ে মাতামাতি করছেন জানি না, তাঁরা এই দিকগুলো ভেবে দেখেন কি না। এই বিষয়গুলো নজরে আনলে আমাদের মত দেশে ভোটের ক্ষেত্রে ইভিএমন এর বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করতেন অযথা যন্ত্র বা ডিজিটাল হুজুকে না মেতে জনগণের পক্ষে একটি নির্বাচনকে কিভাবে পরিচালিত করা যায় তার দিকগুলো নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হত। যা একদমই দেখা যাচ্ছে না।
তাই বলে ইভিএম অকেজো ধারণা তা বলছি না। যন্ত্রের কোন আদর্শ থাকে না, থাকে মানুষের। কাজেই মানুষের নীতিবোধ ঠিক না হলে যন্ত্র ব্যবহার হবে অনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। অন্যদিকে কিভাবে ইভিএমকে কার্যকরি করা যায় তা নিয়েও ভাববার অবকাশ আছে। যেমন, যদি ইভিএম পদ্ধতির ভেতরেই ইন্ডিভিজুয়াল ভোটার আইডেন্টিটির প্রোটেকশন মেকানিজম সংযোগ করা যায় তাহলে ভোট চুরির লাগামহীনতা রোধে তা কর্যকর হতে পারে। সেক্ষেত্রে আইডেন্টিটি দুই ধরণের হতে পারে-
১. একটা হল প্রত্যেক ভোটারের পিন কোড বা পাস কোড যা গোপন চিঠিতে বা মেইলে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
তবে আমাদের মত দেশে, স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত নাগরিকের অনেকের জন্যই পিন পাস ঝামেলাপুর্ণ মনে হতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে নাগরিককে “কিউআর” কোডের ব্যালট পাঠানো যায় (তবে সেক্ষেত্রে ইভিএমকে কিউআর রিডিং সক্ষমতায় আসতে হবে, সেটা আবার খরুচেও)। কিউআর কোড সংযুক্ত ব্যালট স্ক্যান করলে তার ন্যাশনাল আইডির ডেটা চলে আসবে, ফলে ভোটার ভেরিফাইড হবে। এবং ইভিএম এ ভোট দিতে পারবেন।
২. অন্যটা হল বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আইরিশ স্ক্যান। এখানে ডিজিটাল বা এনালগ কোন ধরণের পেপার ব্যালটের ঝামেলা নাই।
তবে বায়োমেট্রিক সিস্টেম দ্রুতগতিতে ভোট কাস্ট করতে প্রতিবন্ধক হবে, বাংলাদেশের বহু কায়িক শ্রমিকের ফিঙ্গার স্ক্যান রিডেবল হবে না। অন্যদিকে আইরিশ স্ক্যান ফিঙ্গার প্রিন্টের ইনপুট থেকে আরও বেশি সময় সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে একই পোলিং সেন্টারে বহু পোলিং বুথের দরকার পড়বে এবং বেশি বেশি সংখ্যক বায়োমেট্রিক সক্ষমতার ইভিএম লাগবে যা নির্বাচনী খরচকে লাগামহীন করবে। অর্থাৎ ইভিএম এর খরচের অসম্ভব ও অবাস্তব হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে উচ্চ সক্ষমতার ইভিএম ব্যবস্থাপনায় বেশি বেশি দক্ষ লোকও দরকার। সব মিলে ইভিএম অত্যাধিক ব্যয়বহুল। এবং আমাদের দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারিগরি দিক, খরচের দিক এবং রাজনৈতিক সংষ্কৃতির দিক থেকে এই পদ্ধতী কোন ভাবেই কাজের কিছু হবে না আমাদের জন্য। তবে ভবিষ্যতের জন্য এই পদ্ধতী নিয়ে গবেষণা ও এটাকে আরও উন্নত এবং সুষ্ঠ নির্বাাচনের উপযোগী করতে গবেষণা অব্যাহত রাখা দরকার। তবে এখই প্রয়োগের কোন যৌক্তিকতা নাই।
আরও একটি দিক ভেবে দেখা দরকার তা হল, বর্তমানের দেশীয় প্রযুক্তিতে কতটা সাশ্রয়ী ভাবে কিউআর কোড বা বায়োমেট্রিক ডেটা রিডিং ক্যাপাবল (সক্ষমতা) ইভিএম তৈরি করা যাবে তার এনালাইসিসও করা চাই সবার আগে। সেই ভিত্তিতে গবেষণা, কস্ট মডেল ও উৎপাদন পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ নিয়ে ভাবতে হবে।
বায়োমেট্রিক সিস্টেমের আরেক সমস্যা হচ্ছে, উভয় আইডেন্টিটির প্রয়োগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি ভোটার কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন তা বের করে ফেলা যাবে। ফলে নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সংরক্ষণ করা যাবে না। ভোট পরবর্তীতে যদি না আইডেন্টিটির বিপরীতে প্রদত্ত ভোটের ম্যাপিং সিস্টেমে জমা না করা হয় (সেভাবে সিস্টেম সফটওয়্যার ডিজাইন করতে হবে)। তবে এটা নাগরিক নিরাপত্তার দিক থেকে একটি ভয়াবহ বিষয়ে পরিণত হবে। মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী হবে না।
আবার আইডেন্টিটির বিপরীতে প্রদত্ত ভোটের ম্যাপিং সার্ভার সিস্টেমে জমা না করার অসুবিধা হল- ভোট চলার সময়ে ইভিএম হ্যাং করলে ইতিমধ্যেই প্রদত্ত ভোটের হিসাব পাওয়া ঝামেলার হবে কিংবা ভোট রি-কাউন্টে সমস্যা হবে।
সব মিলিয়ে একদিকে পাসকোড বিহীন ইভিএম ভোট ডাকাতি তরান্বিত করবে, অন্যদিকে সুরক্ষাহীন সফটওয়্যার ডিজাইন ভবিষ্যতে নাগরিককে রাজনৈতিক হয়রানির উপলক্ষ তৈরি করবে অন্যদিকে উচ্চ কারিগরি সক্ষমতার ইভিএম তৈরি ও ব্যবস্থাপনাও ঝামেলাপূর্ণ এবং বেশ খরুচে।
বাংলাদেশে প্রসাশনের কাছে প্রায় শতভাগ নাগরিকের ডিজিটাল ডেটা আছে, আছে এড্রেস, ন্যাশনাল আইডিতে বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার প্রিন্ট এমনকি আইরিশ স্ক্যানও আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে নাগরিক ডেটার গোপনীয়তা রক্ষায় ইউরোপীয় ‘জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন- জিডিপিআর’ এর আদলে কোন নাগরিক ডেটা সুরক্ষা আইন তৈরি হয়নি। যা আমাদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে ইতমধ্যে। তাই আসলেই প্রশাসন নাগরিকের ডেটা সিকিউরিটির সর্বোচ্চ গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা না দিলে অপরাধপ্রবণ এবং দুবৃত্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে ইলেকট্রনিক ভোটের মত অত্যাধুনিক সিস্টেমও খুবই বিপদের কারণ হবে। কারিগরি উদ্ভাবক এবং ব্যবস্থাপকদের জন্য এটা একটা বিশাল হতাশার ব্যাপার বটে।