কাকা কাহিনী

কাকা কাহিনী

ফুটবল প্রেমীদের বুকের গোপন ঘরে বাসা বেধেছেন তো সেই কবেই। কিন্তু, মাত্র কিছু দিন আগেও যিনি ছিলেন বর্তমান। এক ঘোষণাতেই পরিণত হলেন মনে পড়া ব্যক্তিতে। তার পরিচয়? রিকার্ডো আইজেকসন দস সান্তোস লেইতে কাকা।

বুফনের বিদায়ের ঘোষণায় যখন ফুটবল বিশ্ব অশ্রুসজল তখন মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়সেই কাকার বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা সে চোখগুলো যেন বানের ডাক দিয়েছে। পুরো বিশ্বে হাতে গোনা যে কয়জন ব্যাক্তি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই সমান ভাবে সমাদৃত কাকা ছিলেন তাদেরই একজন। গ্লোবো টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অবশ্য ফুটবলের সাথে থাকার কথা জানিয়েছেন। ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন নিজের প্রিয় ক্লাব মিলানে ফেরার।

ছোট ভাই রড্রিগোর রিকার্ডো উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাই রিকার্ডো কে ডাকতেন কাকা নামে। আর সে নামটিই হয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম। বেশ স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান কাকা ফুটবলের সাথে খেলতেন টেনিসও। আট বছর বয়সে পুরো পরিবার সাও পাওলোতে বসত গড়লে জীবন পথ নির্ধারণ হয়ে যায় কাকার। যোগ দেন স্থানীয় ক্লাব অ্যালফাভিলে, যে ক্লাবটি স্থানীয় এক প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠেছিলো সেবার। সেখানেই সাও পাওলোর এক স্কাউট আবিষ্কার করেন তাকে, এবং কাকাকে প্রস্তাব দেন সাও পাওলোর যুব দলের হয়ে খেলার। যুব দলের হয়ে আলো ছড়িয়ে সাও পাওলোর মূল দলের হয়ে প্রথমবার মাঠে নামেন পয়লা ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে। সে মৌসুমে ২৭ খেলায় করেছিলেন ১২ গোল। ভুমিকা রেখেছিলেন তোর্নিও রিউ সাও পাওলো চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে। ব্রাজিলিয়ান এ ক্লাবের হয়ে মোট ৫৮ বার মাঠে নামেন কাকা, করেন ২৩ গোল।

সাও পাওলোর হয়ে কাকার নৈপুণ্য নজর কারে অনেকেরই। সবচেয়ে বেশী ইতালিয়ান জায়ান্ট মিলানের। ২০০৩ সালে ৮.৫ মিলিওন ইউরো দিয়ে কাকাকে সান সিরোতে নিয়ে আসেন মিলান বস সিলভিও বার্লুসকোনি। ফুটবলের কালো মানিক কাকাকে বিশেষায়িত করেছিলেন ‘বিশেষ একজন’ হিসেবে। স্বয়ং ফুটবল সম্রাট যাকে বিশেষ প্রতিভা বলে মনে করেন তিনি আসলে কতটা কি করতে পারবেন তা নিয়ে যারা সন্দিহান ছিলেন তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্যই যেনো বেছে নিলেন মিলানকে। আগমনের এক মাসের মধ্যেই রুই কস্তার জায়গায় মাঠে নামেন কাকা। প্রথম মৌসুমেই মিলানের হয়ে নজর কাড়েন তিনি। যোগানদাতা ছিলেন স্কুডেট্টো নির্ধারনী শেভচেঙ্কোর গোলটির। এ দলটিই পরে হয়ে উঠে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল। কাকা, পিরলো, গাত্তুসো, শেভা, ইনজাঘিদের নিয়ে গড়া সে দলটি নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছিল সবার। বলতে নেই, এর নেতৃত্বে ছিলেন এ ব্রাজিলিয়ান জাদুকরই। ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’ কাকার স্বপ্নভঙ্গ করে নির্মম ভাবে। কি দারুনই না ছিলেন সে মৌসুমে। বল পায়ে অসম্ভব সব কাজ যেন এখনও শিহরণ জাগায় ফুটবল প্রেমীদের মনে। সেবার না পারলেও ২৩ মে ২০০৭ এ ঠিকই পেরেছিলেন সান সিরোকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে উল্লাসে মাতাতে। এবারও প্রতিপক্ষ ছিলো সেই লিভারপুলই। সাফল্যের সে বছরটিতে জেতেন ফিফা বর্ষসেরার খেতাব। মেসি রোনালদোর যৌথ রাজত্ব শুরুর পূর্বে সেটাই ছিল শেষবারও কারও ব্যালন জয়ের ঘটনা। আলো ছড়িয়েছিলেন ক্লাব বিশ্বকাপের মঞ্চেও। আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সকে ফাইনালে হারানোর ম্যাচটিতে ছিলেন অসাধারণ। ৪-২ গোলের সে জয়ে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিলেন তিনটি গোলে। ঘোষিত হয়েছিলেন আসর সেরা হিসেবে। এমনি এমনি তো আর ফুটবল সম্রাট কালো মানিক পেলে কাকাকে একজন পরিপূর্ণ খেলোয়াড় বলেননি। নিজ রাজত্ব কালে দেখিয়েছেন মুগ্ধতা কিভাবে জাগাতে হয়। এতেও কি আসলে বোঝা যায় কাকা কতটা অসাধারণ ছিলেন?

কাকা কতটা অসাধারল ছিলেন তার কিছুটা আঁচ করা যায় ফুটবলের পিকাসো আন্দ্রেই পির্লোর এক বয়ানে। কাকার মিলান ত্যাগ নিয়ে করা এক মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন “আমার মনে আছে কাকা যখন মিলান ছাড়ে আমরা কতটা আহত হয়েছিলাম। দুই তিন বছর সেই ছিল বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এমন একটা মুহুর্ত ছিল যখন প্রতিপক্ষের কোন ধারণাই ছিল না কিভাবে তাকে আটকাবে তারা।”

২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারী বিবিসি জানায় কাকাকে পেতে ১০০ মিলিওন পর্যন্ত খরচ করতে রাজি ইংলিশ ক্লাব ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। এ গুজবের প্রতিক্রিয়ায় কাকা বলেছিলেন তিনি মিলানেই বুড়ো হতে চান, স্বপ্ন দেখেন একদিন মিলানের অধিনায়কত্ব করবার। তবে সাথে এও বলেন, যদি মিলান আমাকে বিক্রি করে দিতে চায় আমি আলোচনায় বসব। কিন্তু যতদিন ক্লাব তা না চাইবে আমি অবশ্যই মিলানে থাকব। তখনও মনে হচ্ছিল সিটিই কাকার পরবর্তী গন্তব্য। কেননা মিলান মালিক বার্লোসকুনি কাকার জন্য সিটির অফিসিয়াল বিডের কথা কবুল করেছিলেন। মিলানের আর্থিক দুরাবস্থার সুযোগ নেয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যাক্তিটিই যেন আবারো ফিরলেন ফুটবল দুনিয়ায়। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। নতুন গ্যালাক্টিকোসের স্বপ্ন দেখিয়ে পুনরায় মাদ্রিদ রাজত্বে ফেরা পেরেজ ফিরেই নজর দিলেন কাকার দিকে। সে সময়কার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়ে মাদ্রিদে আনলেন কাকাকে।

মিলানের হয়ে ১৯৩ ম্যাচে ৭০ গোল করা কাকার তখন জেতা হয়ে গিয়েছে একবার করে সি আর, সুপারকোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউয়েফা সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। ব্যর্থতার চোরাবালিতে আটকে যাওয়া মাদ্রিদকে উদ্ধারের জন্য তখন তার চেয়ে উপযুক্ত মনে হয় কেউই ছিল না। তবে এই গল্পের শেষটা সাফল্যের নয়। বরং বার্নাব্যুতে আসার পর থেকে আলোকোজ্জ্বল কাকার আকাশে জমতে থাকে শঙ্কার মেঘ। বার্নাব্যুতে যখন মানিয়ে নিচ্ছেন তখনই অনাহুতু ইনজুরির আগমন। যা তাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয় দীর্ঘ সময়ের জন্য। তখন ডাগ আউটেও বদলে গিয়েছে মুখ। চূড়ান্ত পেশাদার হোসে মোরিনহো ইনজুরি ফেরত কাকাকে বাদ দিয়েই পথ চলতে চাইলেন। তবে এর মাঝেও যতবার মাঠে নেমেছেন নিজের জাত চিনিয়েছেন কাকা। কিন্তু কখনো আঘাত কখনও বা মোরিনহোর খেয়ালের সাথে অচেনা অফ ফর্মের আচমকা জানান দেয়া অস্তিত্ব কাকাকে দিন কে দিন যেন ব্রাত্য করে তোলে। তাই ২০১৩ তে ইচ্ছে প্রকাশ করেন মাদ্রিদ ত্যাগের। ফিরে যান নিজের পুরনো আস্তানা সান সিরোতে।

মিলানে এক মৌসুম কাটিয়ে মাদ্রিদের আরেক তারকা ডেভিড বেকহ্যামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যোগ দেন এমএলএস এর ক্লাব অর্লেন্ডো সিটিতে। মাঝে এক মৌসুম ধরে খেলেন নিজের যাত্রা শুরু যে ক্লাবের হয়ে সে সাও পাউলোতে। যেখানে ১৯ খেলায় করেন দুটি গোল।

জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচীর সর্বকনিষ্ঠ দূত কাকা জাতীয় দলের হয়েও আলো ছড়িয়েছেন অনেকটা সময়। ব্রাজিলের হলুদ জার্সি গায়ে ৯২ বার মাঠে নামার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাকার ঝুলিতে রয়েছে একবার বিশ্বকাপ এবং দুইবার কনফেডারেশন কাপের শিরোপা।

পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের জনক কাকা প্রথমবার বিয়ের পিড়িতে বসেন ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর। নিজের বাল্যকালের ভালোবাসা ক্যারোলিন সেলিকোর সাথে। দশ বছর একত্রে থাকার পর ২০১৫ সালে বিচ্ছ্যেদের ঘোষণা দেন সুদর্শন এ জুটি। এর মাঝে ২০০৮  সালের ১০ জুন কাকা ক্যারোলিনের ঘর আলো করে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান লুকা। ২০১১ এর ২৩ এপ্রিল জন্ম নেয় তাদের কন্যা ইসাবেলা। ক্যারোলিনের সাথে বিচ্ছেদের পর বেশীদিন হৃদমন্দির খালি থাকেনি এ সুদর্শন তারকার। এখন সেখানে পূজো হয় মডেল তারকা ক্যারোলিনা ডায়াজ। তবে গল্পটা থেমে যেতো পারতো অনেক আগেই। আঠারো বছর বয়সে মারাত্বক এক পুল দুর্ঘটনায় যখন ক্যারিয়ারে যতিচিহ্ন বসবার উপক্রম তখনই আশ্চর্যজনক ভাবে ফিরে এসেছিলেন তিনি। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ফুটবল বিশ্বের স্বীকৃত প্রায় সমস্ত শিরোপাই জিতেছেন তিনি।

মিলানের হয়ে ২০০৩-০৪ এ সিরি আ, ০৪ এ সুপারকোপ ইতালিয়ানা, ০৬-০৭ এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউয়েফা সুপার কাপ, এবং ক্লাব বিশ্বকাপ জেতা কাকা মাদ্রিদের হয়ে ১১-১২ মৌসুমে লা লিগা, ১০-১১ তে কোপা দেল রে এবং ২০১২ তে জিতেন সুপার কোপা দ্য এস্পানা। এর আগে ২০০১ এ সাও পাওলোর হয়ে জেতেন তোর্নেও রিউ সাও পাওলোর শিরোপা।

দলীয় অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অর্জনও বেশ সমৃদ্ধ এ তারকার। সিরিআ-র সেরা বিদেশি খেলোয়াড়ের খেতাব জেতেন দুই হাজার চার, ছয় এবং সাত সালে। সিরিআ-র বর্ষসেরা হন চার এবং সাতে। ০৪-০৫ মৌসুমে নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউয়েফার ক্লাব পর্যায়ের বর্ষসেরা মিড ফিল্ডার হিসেবে। তিনবার করে স্থান পেয়েছেন ফিফ প্রো এবং ইউয়েফার বর্ষসেরা দলে। ২০০৭ সালে জেতেন ফিফ প্রো বর্ষসেরা, ফিফা বর্ষসেরা, ওয়ার্ল্ড সকার প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার, আইএফএফএইচএস এর বর্ষসেরা প্লে-মেকার, আইএএএফ লাতিন বর্ষসেরা ক্রীড়া তারকা, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলের খেতাব। মিলান এর হল অফ ফেম এ স্থান পান ২০১০ সালে।

শুধু ক্লাব পর্যায়েই না বরং সমান সফল ছিলেন জাতীয় দলের হয়েও। একবারের বিশ্বজয়ী এ তারকা সেলেসাওদের হয়ে মাঠে নেমেছেন ৯২ বার। বিশ্বকাপের পাশাপাশি দুবার জিতেছেন কনফেডারেশন কাপও।

দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত
কাল সারারাত তার পাখা ঝরে পড়েছে বাতাসে
চরের বালিতে তাকে চিকচিক মাছের মতো মনে হয়
মনে হয় হৃদয়ে আলো পেলে সে উজ্জ্বল হতো।
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়

কাকার যা কিছু অর্জন তাতে ফুটবলের আকাশে তিনি যে চিরকাল উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই জ্বলবেন তাতে দ্বিমত পোষণকারী ফুটবল পন্ডিত বোধ করি এখনো জন্মায়নি। স্বমহিমায় উজ্জ্বল এই তারকার জীবনে মাদ্রিদ হয়তো হয়ে থাকবে এক আফসোসের নাম। চাইলে দুষতে পারেন ভাগ্যকেও। নতুবা, যেভাবে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাতে আচমকাই ইনজুরি হানা না দিলে হয়ত আরও বেশ কিছুদিন রাজ করতেন ফুটবল দুনিয়ায়।